একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হয়েছে সোমবার (২৯ জানুয়ারি)। আজ থেকে শুরু হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা। প্রথম অধিবেশনের জন্য সব প্রস্তুতি শেষ করেছে সংসদ সচিবালয়।
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) বিকাল ৩টায় বসবে সংসদের প্রথম অধিবেশন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে টানা চতুর্থবারের মতো রকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। একাদশ সংসদের মতো এবারও স্পিকার হিসেবে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার পদে শামসুল হক টুকুকে মনোনীত করেছে দলটি। সংসদে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এবারও ভোটে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুই বিজয়ী হবেন।
প্রথম অধিবেশনে নির্বাচিত করা হবে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। এরপর ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। এরইমধ্যে সংসদ নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও উপনেতা মতিয়া চৌধুরী। বিরোধী দলীয় নেতা হয়েছেন জাতীয় পার্টির জি এম কাদের ও উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের যাবতীয় প্রস্ততি সম্পন্ন করেছে সংসদ সচিবালয়। ইতোমধ্যে নতুন সংসদের সদস্যদের আসন বিন্যাস করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত এমপিদের সংসদের কার্যক্রম বিষয়ে দুই দিনব্যাপী ওরিয়েন্টশন দেওয়া হয়েছে।
সংসদের অধিবেশন উপলক্ষে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ এলাকায় যান চলাচল সীমিত করা হয়েছে। প্রথম অধিবেশন সংসদ থেকে সরাসরি দেখার জন্য বিদেশি কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
প্রথম দিনের কার্যসূচিতে ৫টি কাজের কথা বলা আছে। এগুলো হলো- স্পিকার নির্বাচন, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন, শোকপ্রস্তাব ও রাষ্ট্রপতির ভাষণ। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পরই প্রথম দিনের বৈঠক মুলতবি করা হবে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনের এটাই হবে সংসদে প্রথম ভাষণ। মন্ত্রিসভার গত বৈঠকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মূলত মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ভাষণই রাষ্ট্রপতি সংসদে পাঠ করেন। প্রথম দিনের বৈঠক মুলতবির পর পরবর্তী দিনের বৈঠকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হবে। এরপর থেকে ওই প্রস্তাবের ওপর সংসদ সদস্যরা আলোচনা করবেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ নেতা ও দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী দ্বাদশ সংসদের সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করবেন। এদিকে সংসদে সরকারের বিরোধীতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দলের নেতা হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) বিরোধী দলের নেতা ও দলের কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বিরোধী দলীয় উপনেতার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এর আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন একাদশ সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরীকে দ্বাদশের চিফ হুইপ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া ইকবালুর রহিম (দিনাজপুর-৩), আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন (জয়পুরহাট-২), মো. নজরুল ইসলাম বাবু (নারায়ণগঞ্জ- ২), সাইমুম সরওয়ার কমল (কক্সবাজার-৩) এবং মাশরাফী বিন মোর্ত্তজাকে (নড়াইল-২) হুইপ নিয়োগ দিয়েছেন। সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ নিয়োগের আইনত কোনো বিধান না থাকলেও অতীতের রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তার মহাসচিব মজিবুল হককে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও দলের সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদকে বিরোধী দলীয় হুইপ মনোনীত করেছে।
সংসদ অধিবেশনের প্রস্তুতি সম্পর্কে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, অধিবেশনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সংসদের আসন বন্টন হয়েছে। আমরা নতুন এমপিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। দ্বাদশ সংসদ প্রাণবন্ত হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার স্বীকৃতি প্রসঙ্গে স্পিকার বলেন, কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সরকারের বিরোধীতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দলের নেতা হিসেবেই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিধি অনুযায়ীই এটা করা হয়েছে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কোনও দলের না হওয়ায় তারা সংখ্যায় বেশি হলেও তাদের মধ্য থেকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে কাউকে স্বীকৃতি দেওয়ার সুযোগ নেই।
সরকারি দলের প্রথম সারিতে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশের আসনটি সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং তার পরের আসনটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে। এ ছাড়া প্রথম সারিতে আসন পেয়েছেন তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সংসদ নেতার পেছনের সারির প্রথম আসনে সরকারি দলের চিফ হুইপ নুর-ই- আলম চৌধুরী বসবেন।
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার আসন জিএম কাদের এবং বিরোধীদলীয় উপনেতার আসন আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিরোধী দলের প্রথম সারিতে বিরোধীদলীয় উপনেতার পাশের আসনটি জাপার রুহুল আমিন হাওলাদার এবং তার পরের তিনটি আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্বতন্ত্র এমপি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ও ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননকে। বিরোধী দলীয় নেতার পেছনের সারির প্রথম আসনে বিরোধী দলের চিফ হুইপ মজিবুল হক চুন্নু বসবেন। এছাড়া বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের আশপাশে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের আসন দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, সংসদ অধিবেশন চলাকালে জাতীয় সংসদ ভবন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কিছু বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। রবিবার ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এক আদেশে এসব নিষেধাজ্ঞার কথা জানান। আদেশে সোমবার রাত ১২টা থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য, অন্যান্য ক্ষতিকারক ও দূষণীয় দ্রব্য বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনও প্রকার সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রদর্শন ইত্যাদি নিষেধ করা হয়েছে।
যেসব এলাকায় এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে—ময়মনসিংহ রোডের মহাখালী ক্রসিং থেকে পুরাতন বিমানবন্দর হয়ে বাংলামোটর ক্রসিং পর্যন্ত, বাংলামোটর লিংক রোডের পশ্চিম প্রান্ত থেকে হোটেল সোনারগাঁও রোডের সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত এবং পান্থপথের পূর্ব প্রান্ত থেকে গ্রিন রোডের সংযোগস্থল হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত। মিরপুর রোডের শ্যামলী মোড় থেকে ধানমন্ডি-১৬ (পুরাতন-২৭) নম্বর সড়কের সংযোগস্থল ও রোকেয়া সরণির সংযোগস্থল থেকে পুরাতন নবম ডিভিশন (উড়োজাহাজ) ক্রসিং হয়ে বিজয় সরণির পর্যটন ক্রসিং, ইন্দিরা রোডের পূর্ব প্রান্ত থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পশ্চিম প্রান্ত, জাতীয় সংসদ ভবনের সংরক্ষিত এলাকা এবং এই সীমানার মধ্যে অবস্থিত সমুদয় রাস্তা ও গলিপথ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ আদেশ বলবৎ থাকবে বলেও জানানো হয়েছে।
গেলো ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২৯৯টি আসনের ফলাফলে ২২৩টিতে জয় পায় আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি আসনে জয় পেয়েছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পেয়েছে। আর ৬২টি আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
এরপর ৯ জানুয়ারি নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরদিন ১০ জানুয়ারি শপথ নেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। একদিন পর ১১ জানুয়ারি শপথ নেন নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। এর মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পঞ্চম মেয়াদে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন।