গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনার ছয় বছর হলো আজ (১ জুলাই)। সেদিন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এ হামলায় জঙ্গিরা ইতালির নয় জন, জাপানের সাত জন, ভারতীয় একজন ও বাংলাদেশি তিনজন নাগরিকসহ ২২ জনকে হত্যা করেছিল। এরমধ্যে জঙ্গিদের নিক্ষেপ করা গুলি ও বোমায় দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। আহত হন পুলিশের আরও অনেকে । এছাড়া ঘটনাস্থলে জিম্মি অবস্থায় থাকা দেশি-বিদেশি নাগরিক ও বেকারির স্টাফসহ প্রায় ৩৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল।
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ঢুকেই জঙ্গিরা জিম্মি করে ফেলে অবস্থানরত সবাইকে। জিম্মির এ ঘটনা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। ভয়াবহ এ হামলায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের ঘটনা স্তম্ভিত করেছিল পুরো জাতিকে। কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়েও রাতে অভিযান চালায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার। অভিযানে মৃত্যু হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গির।
হামলা শুরুর দুই ঘণ্টা পর আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টায় সন্ত্রাসীরা পুলিশ অফিসার ও ফোর্সদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে অন্তত ২৫ জন পুলিশ মারাত্মক জখম হন। এরপর ঘটনাস্থলে যান তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ডিএমপি, র্যাবসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অফিসার ও ফোর্স। কর্ডন করা হয় হলি আর্টিজানকে। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয় গোটা গুলশানকে।
রাত দেড়টায় ইন্টারনেটে হামলাকারী পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ২ জুলাই সকাল আনুমানিক ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে জিম্মিদের উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব জঙ্গিদের নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তারা। পরে নিহত ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নামে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। চলে একের পর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গি।
আটকের পর তাদের মুখে উঠে আসে নৃশংস সেই হামলার বর্ণনা। তারা জানান, প্রায় দেড় বছর আগে পরিকল্পনা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে নৃশংস এ হামলা সরাসরি বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেওয়া হয় আত্মঘাতী পাঁচ জঙ্গিকে। হামলার প্রথম ২০ মিনিটেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। সেদিন জঙ্গিরা দেশি-বিদেশিদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে বা গলাকেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। হত্যার পর ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে বাইরে অবস্থানরত নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী ও মারজানের কাছে পাঠায় তারা।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে মামলার আট আসামির সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে বেকসুর খালাস দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালত। এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডও দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— গাইবান্ধার জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, নওগাঁর আসলাম হোসেন ওরফে আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ, কুষ্টিয়ার আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, জয়পুরহাটের হাদীসুর রহমান ওরফে সাগর, বগুড়ার রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও রাজশাহীর শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ। খালাস দেওয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে।
তবে হলি আর্টিজানে দায়ের করা মামলায় বিচারিক আদালতে দেওয়া রায়ের পর প্রায় আড়াই বছর কেটে গেলেও সাজাপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স এবং তাদের খালাস চেয়ে করা জেল আপিল হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল শুনানির জন্য বিচারিক আদালত থেকে মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। তবে আপিল শুনানির জন্য সব নথিপত্র একত্রিত করে পেপারবুক তৈরি করতে নথিপত্রগুলো সুপিম কোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা থেকে বিজি প্রেসে পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, পেপারবুক প্রস্তুত হয়েছে বলে জেনেছি। তবে মামলাটি দ্রুত শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণে প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ করব।
আসামিপক্ষে আইনজীবী না থাকলে রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
মির্জা রুমন