কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছেন। এসময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এর পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে সব রকম সহিংসতার দ্রুত, স্বচ্ছ এবং পক্ষপাতিত্বহীন তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তিনি। অনেকটা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হলে তার ম্যান্ডেট অনুসারে তিনি পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছেন। জাতিসংঘের চিহ্ন সম্বলিত সরঞ্জাম ব্যবহার করার কড়া সমালোচনাও করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় সোমবার(২৯ জুলাই) জাতিসংঘের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এসব তথ্য জানান। ব্রিফিংয়ে প্রথমে তিনি বাংলাদেশ ইস্যুতে একটি বিবৃতি পাঠ করেন।
বিবৃতিটি হলো, ‘বাংলাদেশ ইস্যুতে আমার কাছে আপডেট আছে। আমি আপনাদের বলতে পারি যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি নতুন করে ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার বিষয়ে অবহিত এবং তিনি শান্ত ও সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমান ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে হাজারো তরুণ এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের গণগ্রেপ্তারের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁ। এ বিষয়ে রাজধানী ঢাকায় এবং নিউ ইয়র্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জাতিসংঘের উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে সেনা পাঠানো শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আমরা মানবাধিকারের প্রতি সম্মান ও সমুন্নত রাখার আহ্বান জানাই। বাংলাদেশের ভেতরে জাতিসংঘের চিহ্ন সম্বলিত কোনো যানবাহন আর ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে বাংলাদেশ সরকারের বিবৃতি আমরা পেয়েছি।
আমরা এটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই এবং আবারও বলতে চাই যে, জাতিসংঘে সেনা ও পুলিশ দিয়ে অবদান রাখা দেশগুলো শুধু তখনই জাতিসংঘ চিহ্নিত এবং জাতিসংঘের চিহ্ন সম্বলিত সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে, যখন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের অধীনে তাদেরকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে কোনো ম্যান্ডেটেড কাজ দেওয়া হয় তখন।’
ডুজারিকের বিবৃতির পর প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশ প্রতিদিনের নিউইয়র্ক প্রতিনিধি লাভলু হাসান একটি প্রশ্ন করেন। তার প্রশ্নটি ছিল, ‘বাংলাদেশ সরকার পুনর্ব্যক্ত করেছে যে সব হত্যাকাণ্ড এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ন্যায়বিচার করা হবে এবং পক্ষপাতিত্বহীন এবং বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া হবে। এসব পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?’
জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো ঠিক দুই মিনিট আগে যেটা বলেছি সেটা। তাতে সব রকম সহিংস ঘটনার যথাযথ তদন্ত হতে হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং পক্ষপাতিত্বহীনভাবে। এসব সহিংসতায় জড়িতদের সবাইকে জবাবদিহিতায় আনতে হবে।’
এক পর্যায়ে লাবলু আনসার আবার জানতে চান,
‘আমার আরও জানার আছে। সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর ঢাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি সম্পদের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। এ রকম একটি ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়ে বাংলাদেশকে কি কোনো সহায়তা দেবে জাতিসংঘ?’
জবাবে ডুজারিক বলেন, ‘সংকটের সময় যেকোনো দেশকে আমরা সবসময় সংলাপে সহায়তা করতে প্রস্তুত। বিশ্বের কোথাও প্রতিবাদ বিক্ষোভের সময় যেসব মানুষ দুঃখজনকভাবে তাদের সম্পদ হারান অথবা পরিবারের সদস্যদের হারান- তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোনো স্কিমের সঙ্গে জাতিসংঘ জড়িত নয়।’
এর পরই অনলাইনে যুক্ত হয়ে খালেদা জিয়ার সাবেক সহকারী প্রেস সচিব মুশফিকুল ফজল আনসারী প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ইস্যুতে আমার তিনটি প্রশ্ন আছে। তা খুব দ্রুত হবে। বাংলাদেশে তরুণ নিরপরাধ জনগণের বিরুদ্ধে গুলি করে এবং তাদেরকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জোরপূর্বক বিবৃতি দেওয়ানোর কূটকৌশল (উইচ হান্ট) চালাচ্ছে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সি। এতে তাদের ভূমিকার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের পর্যবেক্ষণ কি?’
জবাবে স্টিফেন ডুজারিক বলেন- ‘মুশফিক, আমি পুনরাবৃত্তি করছি। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, বাংলাদেশে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট আছে। এসব রিপোর্টে উদ্বেগ জানিয়েছেন মহাসচিব। এসব নিয়ম লঙ্ঘনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে জবাবদিহিতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।’
দ্বিতীয় প্রশ্নে মুশফিকুল ফজল আনসারী জানতে চান, ‘এই একই বাহিনী অন্য দেশগুলোতে থাকা জাতিসংঘের পতাকাতলে এসব লোকদের নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব স্বস্তি প্রকাশ করেন?’
এ প্রশ্নের জবাবে স্টিফেন ডুজারিক বলেন, ‘এটা পরিষ্কার যে আমরা বাংলাদেশের ওপর এবং বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ওপর নির্ভর করি। তারা মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে এবং এর সম্মানার্থে শান্তিরক্ষী মিশনগুলোতে কাজ করে চলেছেন। আপনার শেষ প্রশ্ন কি?’
তৃতীয় প্রশ্নে মুশফি ফজল জানতে চান, ‘জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান বলেছেন, তার অফিস তাদের (বাংলাদেশের) তদন্তে সহায়তা করতে প্রস্তুত। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞজন এবং নোবেলবিজয়ীরা পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি জানিয়ে আসছেন। এর প্রেক্ষিতে মহাসচিবকে ব্যবস্থা নিতে কতটা তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন হবে।’
এ প্রশ্নের জবাবে ডুজাররিক বলেন, ‘ম্যান্ডেন্টের অধীনে সবসময় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত জাতিসংঘ মহাসচিব।’
এমআর//