শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে মোটেও স্বস্তিতে নেই প্রতিবেশি দেশ ভারত। বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে চিন্তা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বেশ দ্বিধায় রয়েছে নরেন্দ্র মোদি প্রশাসন। শেখ হাসিনা স্থায়ীভাবে ভারতে অবস্থান করলে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়তে দিল্লি বেশ চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। যদি এমনটাই ঘটে তাহলে নয়া দিল্লির কূটনীতি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় এক মাস হতে চলেছে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের তোপের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৫ই আগস্ট নাটকীয়ভাবে ক্ষমতা হারানোর পর একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে তিনিভারতে পালিয়ে যান। দিল্লিতে অবতরণের পর ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয়ের চেষ্টা করছেন। তবে ওই দেশগুলো শেখ হাসিনার আবেদনে সাড়া দেয়নি।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা রয়েছে। প্রথমত তিনি ভারতেই রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে থাকতে পারেন। দ্বিতীয়টি হলো-শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হবে। তবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, হাসিনা স্থায়ীভাবে ভারতে অবস্থানের সুযোগ পেলে দিল্লিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়তে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। আর এমনটাই যদি ঘটে তাহলে দিল্লির কূটনীতি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
দিল্লির কূটনীতি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণ হচ্ছে-ভারতের কাছে বাংলাদেশ শুধুমাত্র প্রতিবেশী দেশই নয়। দিল্লির অন্যতম কৌশলগত অংশীদার হচ্ছে ঢাকা। এছাড়া, ভারতের বিশাল সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ঠ মিত্র হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয় ও সিকিম প্রদেশের জন্য কৌশলগতভাবে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মোট সীমান্ত ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে যদি কখনও বিদ্রোহ দেখা দেয় তাহলে ওই বিদ্রোহ দমন করতে বাংলাদেশের সাহায্য ছাড়া দিল্লির জন্য বেশ কঠিন। কারণটা হলো- প্রদেশগুলোর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে সহজেই প্রবেশ করতে পারবে। প্রবেশ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতিগত বিদ্রোহীদের দমন করতে ভারতের তেমন বেগ পোহাতে হয়নি। কেননা হাসিনা ভারতের সাথে বেশ কয়েকটি সীমান্ত বিরোধও বন্ধুত্বপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করেছিলেন। সীমান্ত নিরাপত্তা মূলে থাকলেও আর্থিক দিকও এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছে ভারত। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কের বিকাশ ঘটে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে সহজে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের সড়ক, নদী এবং রেল পথ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। ২০১০ সাল থেকে ভারত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে। তবে হাসিনার আকস্মিক ক্ষমতা হারানোয় পুনরায় বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা দিল্লির জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এটিকে ভারতের জন্য একটা ধাক্কা বলে মনে করছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী।
ভারতের সাবেক এই কূটনীতিক বলেছেন, ‘এটি এই অর্থে একটি ধাক্কা যে আমাদের আশেপাশে যেকোনো অশান্তি সবসময়ই অবাঞ্ছিত।’তবে জোর দিয়ে বলেছেন, দিল্লি ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কাজ করবে। কেননা এর কোন বিকল্প নেই এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে যা করবে তা ভারত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সময় ক্ষেপণ করেনি। ড. ইউনূস সরকারকে সর্বপ্রথম অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগের প্রতি অটল সমর্থনের করেছে ভারত। একারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধীতার জন্ম নিয়েছে। এটি লাঘবে দিল্লির বেশ সময় লাগবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে তার স্বচ্ছতা নিয়ে দেশটির জনগণের বেশ উদ্বেগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের জনগৈণের এই উদ্বেগে সাড়া দেয়নি ভারত। বরং জনগণের এমন উদ্বেগকে উপেক্ষা করে ক্রমাগতভাবে হাসিনাকে সমর্থন কছে। একারণে দিল্লির প্রতি বাংলাদেশের গনগণের যে আক্রোশ বেড়েছে তা বিগত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। হাসিনা সরকারের পতনের সাথে দিল্লির ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতিটি আরেকবার ধাক্কা খেল। কারণ ভারতের আধিপত্য বিস্তারের যেকোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে মালদ্বীপ এবং নেপালের পথেই হাঁটবে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে মর্যাদা রক্ষা করতে চাইলে দিল্রিকে অন্য প্রতিবেশী দেশে তার প্রভাব বজায় রাখতে হবে। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে ভারতের প্রতিবেশি দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তারের জোরালো চেষ্টা চালাচ্ছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীনও। গত বছর ভারতের চোখের সামনেই ভারত-বিরোধীতা করে মালদ্বীপের ক্ষমতায় এসেছে মোহাম্মদ মুইজ্জু।
বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবিষয়ে বলেন, ভারতের জন্য তার আঞ্চলিক নীতি সম্পর্কে কিছু আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। দিল্লিকে দেখতে হবে তার আঞ্চলিক অংশীদাররা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথভাবে গ্রহণ করেছে কিনা। শুধু বাংলাদেশকেই উদ্দেশ্য করেননি, এই অঞ্চলের সব দেশের কথাই বুঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এটি স্পষ্ট যে, নিকটতম সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই আওয়ামী লীগের। এই সময়ের মধ্যে ভারত যদি আওয়ামী লীগের বিকল্প কাউকে তাদের কাছে টানতে না পারে তাহলে তাদের জন্য্য বিষয়টি খুব জটিল হবে। বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন,ভারত একরকম ভেবেই নিয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারই একমাত্র মিত্র। দিল্লির এটি একটি কৌশলগত ভুল ছিল।’ অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারলে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তবে এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, বিএনপির সাথে ভারতের সম্পর্ক কতটা জোরালো। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের কোনো নজির নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে নিজেদের সম্পর্ক জোরালো করতে চীনও বেশ জোরালো উপস্থিতি জানান দেয়ার চেষ্টা করছে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর চীন সফরে মুইজ্জুকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল চীন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই দৃশ্য নিশ্চয়ই দেখতে চাইবে না ভারত।
এমআর//