আন্তর্জাতিক

ইসরাইলিদের ‘ঘুম কেড়ে নেওয়া’ কে এই সিনওয়ার?

বায়ান্ন আন্তর্জাতিক ডেস্ক

হামাসের শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ছবি: সংগৃহীত

গেলো বছরের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের হামলা, কয়েক শ মানুষকে হত্যা আর চার শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়ার মূল পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তাকে মনে করে ইসরাইল। তখন থেকেই হামাসের এই নেতাকে হত্যার জন্য উঠে পড়ে লাগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার। দীর্ঘ এক বছর ধরে ইসরাইলি সেনাবাহিনী নানাভাবে হত্যার চেষ্টা করলেও তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।  অবশেষে বুধবার (১৬ অক্টোবর) দক্ষিণ গাজা উপত্যকায়  ইসরাইল বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সম্মুখ যুদ্ধে তিনি নিহত হয়েছেন। হামাসের এই শীর্ষ নেতার নাম ইয়াহিয়া সিনওয়ার।

বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত–এর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ৮২৮তম ব্রিগেডের অভিযানে দক্ষিণ গাজায় তিনজন নিহত হন সিনওয়ার। ওই তিনজনের মরদেহের পরিচয় শনাক্তের পর ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি হামাস।

কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়,ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হাতে বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন হামাসের এই নেতা।  জেল খেটেছেন একটানা ২৩ বছর।  ইরানে বিস্ফোরণ ঘটনায় হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর সংগঠনের শীর্ষ পদে আসেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার।  গাজার অজ্ঞাত স্থান থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হামাসের কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। গত ৩১ জুলাই হানিয়ার ওপর ওই হামলার ঘটনায় ইসরায়েল এখনো তার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটি করেনি।

তেহরানে গুপ্তহত্যায় ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর হামাসের রাজনৈতিক শাখার নতুন প্রধান হিসেবে  নিয়োগ পান ইয়াহিয়া সিনওয়ার। গাজায় সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। হানিয়া হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখন হানিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে সিনওয়ারের নাম ঘোষণা করা হয়। হানিয়াকে হত্যার ঘটনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের অঙ্গীকার করেন হামাসের এই নেতা।

১৯৬২ সালে গাজার খান ইউনিস শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা এই নেতার শিক্ষাজীবন গাজাতেই। তরুণ বয়স থেকেই তিনি ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে আরবি সাহিত্য নিয়ে পড়ার সময়  ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন সিনওয়ার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে  আশির দশকের শুরুর দিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে বারবার গ্রেপ্তার হন সিনওয়ার।

গাজা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করার পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যোদ্ধাদের একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় সিনওয়ার সহায়তা করেন। পরবর্তী সময়ে এ নেটওয়ার্ক হামাসের সশস্ত্র শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেড হিসেবে গড়ে ওঠে।  সিনওয়ারের নেতৃত্বে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে হামাসের সামরিক কার্যক্রম।

১৯৮৭ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠা করার পরপরই যাঁরা সংগঠনটির নেতৃত্বে আসেন তাদের মধ্যে ইয়াহিয়া সিনওয়ার একজন।  হামাস প্রতিষ্ঠার পরের বছরই ইসরায়েলি বাহিনী সিনওয়ারকে গ্রেপ্তার করে ও চার দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অর্থাৎ ৪২৬ বছরের সমপরিমাণ কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে।  ইসরায়েলি সেনা ও ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করা সন্দেহভাজন চার ফিলিস্তিনি গুপ্তচরকে হত্যার অভিযোগে সিনওয়ারকে ওই কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

দীর্ঘ ২৩ বছর ইসরায়েলের কারাগারে ইয়াহিয়া সিনওয়ার হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন ইসরায়েলের কূটকৌশল ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। পরে এক বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ২০১১ সালে মুক্তি পান। তাঁর বিনিময়ে বন্দী ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতকে ছেড়ে দেয় হামাস।

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দ্রুতই সিনওয়ার হামাসের শীর্ষ পদে ফেরত আসেন। ২০১২ সালে সংগঠনটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। দায়িত্ব পান সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডের সঙ্গে রাজনৈতিক শাখার কার্যক্রম সমন্বয়ের।

২০১৪ সালে গাজায় সাত সপ্তাহ ধরে ব্যাপক হামলা ও অভিযান চালায় ইসরায়েল। ওই সময় হামাসের উভয় শাখায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন সিনওয়ার। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।

২০১৭ সালে হামাসের গাজা শাখার প্রধান নির্বাচিত হন ইয়াহিয়া সিনওয়ার।স্থলাভিষিক্ত হন ইসমাইল হানিয়ার। হানিয়া তখন সংগঠনটির রাজনৈতিক শাখার প্রধান নির্বাচিত হন। সিনওয়ারের  নেতৃত্বে হামাস বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং গাজার প্রশাসনিক কার্যক্রমে অনেক পরিবর্তন আনে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে ‘সন্ত্রাসী নেতা’ হিসেবে আখ্যা দিলেও  গাজা, লেবানন, ইরাক, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জনগণের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। আজীবন ইসরাইলের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন হামাসের এই শীর্ষ নেতা।

এমআর//

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন সিনওয়ার | হামাস