শিল্পী পরিবারে জন্ম হওয়ায় রক্তেই মিশেছিল সেই সত্ত্বা। যার ফলে নিজের ভেতর থেকে শিল্পীসত্ত্বাকে খুঁজতে বেশি সময় লাগেনি। নেশাকেই পেশা বানিয়েছিলেন তিনি। তিনিই বাঙালিকে বাধ্য করেছিলেন শীতের রাতেও অপেক্ষা করতে শুধুমাত্র তাঁর তালের মূর্ছনা শোনার জন্য।আর তার জন্যই হয়তো আজ সকলের উস্তাদ তিনি। পুরো নাম জাকির হুসেন আল্লারাখা কুরেশী। তবে উস্তাদ জাকির হোসেন নামেই বিশ্ববাসী চিনে তাকে।
স্থানীয় সময় রোববার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ভারতীয় এই তবলাবাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্ষণজন্মা প্রতিভা বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। যে কারণে তার আসন্ন কয়েকটি কনসার্টও বাতিল করা হয়েছিল।
কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী ও তবলাবাদক আল্লা রাখার কুরেশির সন্তান জাকির হোসেন। ১৯৫১ সালের ৯ই মার্চ ভারতের মুম্বাই নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর যখন তাঁকে বাবার কোলে দেওয়া হয়েছিল, তখন কোনও বিশেষ প্রার্থনা বা ভাল মানুষ হওয়ার কথা বলেননি আল্লা রাখা। বলেছিলেন, তবলার বোল “ধাগে তেটে, ধাগে তেটে, ক্রিধা তেটে’।
সেই থেকে শিক্ষার শুরু। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ- রেখেছিলেন তাঁর নাম। কথায় বলে না-তারায় তারা চেনে। হয়তো ওইদিনও জাকির হোসেনের মাঝে ধ্রব তারাটি আবিষ্কার করেছিলেন গুলাম আলি খা।
যেবয়সে মায়ের কোল থেকে শিশুদের নামার কথা নয়, সেই তিন বছর বয়সে তবলায় হাত রেখেছিলেন। বাবা আল্লা রাখার কাছে শিক্ষা শুরু সাত বছর বয়স থেকে। ওই বয়সেই জাকির হোসেন একক মঞ্চানুষ্ঠান করেন।
১৯ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী জাকির হোসেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের সাহচর্যে ১৯৭০ সালে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় জাকির হুসেনের প্রথম অ্যালবাম ,”লিভিং ইন দ্য মেটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড”। সেই থেকে শুরু। ১৯৭৯ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে একাধিক জাতীয়, আন্তর্জাতিক ফেস্টিভালে যেমন তিনি পারফর্ম করেছেন, তেমনই অগুনতি অ্যালবামও প্রকাশ করেছেন ছয় দশকের কেরিয়ারে।
তবে কেরিয়ারে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত ছিল ১৯৭৩ সালে গিটারিস্ট জন ম্যাকলাফলিন, ভায়োলিন বাদক এল শঙ্কর ও ঘটম বাদক টিএইচ ভিক্কুর সঙ্গে যুগলবন্দী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জ্যাজের মেলবন্ধন ছিল, যা ওই যুগে কেউ কল্পনাই করতে পারত না।মোট সাতবার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তজাকির হোসেন। সঙ্গীত শিল্পে অসাধারণ কৃতিত্ব রাখার জন্য প্রবর্তিত এই আন্তর্জাতিক সম্মান চারবার পেয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে ২০০৯ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ৫১তম গ্র্যামি পুরস্কারে মিকি হার্ট ও জোভান্নি হিদালগোর সাথে তাদের যৌথ অ্যালবাম গ্লোবাল ড্রাম প্রজেক্ট-এর জন্য সমকালীন বিশ্ব সঙ্গীত অ্যালবাম বিভাগে এবং ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনটি গ্র্যামি অর্জন করেন।
ভারতীয় সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৮৮ সালে তিনি পদ্মশ্রী ও ২০০২ সালে পদ্মভূষণ সম্মান পান। আর ২০২৩ সালে তাঁকে পদ্মবিভূষণ সম্মান দেওয়া হয়।
বিশ্বখ্যাত এই তবলাবাদক অভিনেতা-মডেলও ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ‘হিট অ্যান্ড ডাস্ট’-এ প্রথম অভিনয়। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৯৮ সালে, রাহুল দেব বর্মণের জীবনের উপরে তৈরি ‘সাজ’ সিনেমায়।
এই সিনেমায় রাহুল দেব বর্মণের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে দেব পাটেলের মাঙ্কি ম্যান সিনেমাতেও নিজের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৯০-র দশকে ব্রুক বন্ড চায়ের বিজ্ঞাপন করেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই লোকমুখে জনপ্রিয় হয়েছিল “বাহ তাজ”।
ভারতের এই বিস্ময়কর প্রতিভা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছেন শুধু সঙ্গীতকে সঙ্গত দেওয়ার জন্য নয়, বাদ্যযন্ত্রই আলাদা সঙ্গীত হয়ে উঠতে পারে। শিল্পীর শেষ হলেও, শিল্প অবিনশ্বর। তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হয়ে থাকবেন জাকির হুসেন।
এমআর//