ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। প্রতিশোধ নিতে দফায় দফায় হামলা চালাচ্ছে ইরানের ইসলামিক বিপ্লব গার্ড কর্পস-আইআরজিসি। দেশটির এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, তেলআবিবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক অভিযানের সময় কমপক্ষে দুই শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে।
ইসরাইলি হামলায় নিজেদের সামরিক বাহিনীর দেড় ডজনেরও বেশি জেনারেল হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে হামলা চালাচ্ছে ইরান। ইসরাইলের দাবি, তারা কিছু ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে পেরেছে, তবে ক্ষতির মাত্রা উল্লেখযোগ্য। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও তিন শতাধিক।
ইসরাইল-ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যেই জাতির উদ্দেশে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনি।দেশটির টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ওই বার্তায় খামেনি বলেন, হামলা চালিয়ে ইসরাইল বড় ভুল করে ফেলেছে আর মারাত্মক এই ভুলের পরিণতিতে অসহায় হয়ে পড়বে দেশটি।
ইরানি জাতি শহিদদের মূল্যবান রক্ত বৃথা যেতে দেবে না মন্তব্য করে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, তাদের সশস্ত্র বাহিনী অবশ্যই এই ঘৃণিত ইহুদিবাদী শত্রুর ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানবে এবং ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে পরাজিত করবে।
এদিকে, কাতারিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর ও বিস্ফারক তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাতে টেনে আনতে চাইছে ইসরায়েল। যাতে তাদের দুই দেশের যুদ্ধের চাপ ইরান সইতে না পারে। স্বভাবতই বিশ্ব পরাশক্তির আঘাত সামলানো ইরানের পক্ষে সহজ হবে না। সেই সুযোগটিই নেবেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে ইরানে শাসন পরিবর্তনের পরিকল্পনা করেছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।ওই প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার ডিকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির অধ্যাপক শাহরাম আকবারজাদেহ বলেছেন, ইসরায়েল এবং ইরান উভয়ই দীর্ঘ সময় ধরে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে থাকার জন্য প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। ফলে পাল্টাপাল্টি আরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই মুহূর্তে ইরান কেবল ইসরাইলের হামলার জবাবে ‘টিট ফর ট্যাট’ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তবে এটা খুবই স্পষ্ট যে- ইরান তার সামরিক কমান্ডার, বিজ্ঞানী, সামরিক স্থাপনা এবং পারমাণবিক সুবিধাগুলোকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলা সহ্য করবে না।
এদিকে, ইরানে শাসন পরিবর্তনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ক্ষমতাসীন কট্টর ইসলামপন্থি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশটির সাধারণ জনগণকে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানান বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
শুক্রবার দিবাগত রাতে সোশ্যাল মিডিয়া এক্সে পোস্ট করা এক ভিডিওবার্তায় ইরানের জনগণকে উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহু বলেন, গত কয়েক দশক ধরে যে অশুভ ও নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠী আপনাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে, তাদেরকে নামানোর সময় এসেছে।
নেতানিয়াহু আরও বলেন, ইরানে তারা যে সামরিক অভিযান শুরু করেছে, তা দেশটির জনগণের বিরুদ্ধে নয়। ইসরাইলের সামরিক অভিযান ইরানের পরমাণু হুমকি ও ক্ষেপণাস্ত্র হুমকির বিরুদ্ধে। তাই নিপীড়নবাদী শাসন থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হোন, আওয়াজ তুলুন। এই সুযোগ আপনাদের সামনে এসেছে, তাকে গ্রহণ করুন।
এদিকে, ঘনিষ্ট মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও ইসরাইলের পক্ষে যাওয়ার আভাস মিলেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায়। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাতকারে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে থাকবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, তিনি ইসরায়েলকে সমর্থন করেন। তবে এ হামলার জেরে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেননি। ট্রাম্প বলেছেন, ‘তারা ইসরায়েলের খুব ঘনিষ্ঠ। মার্কিনীরা ইসরাইলিদের সবচেয়ে বড় মিত্র,’ ‘দেখা যাক, কী হয়।
গেলো ১৩ জুন ইরানে বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। ওই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ ও ইসফাহান অঞ্চলের পারমাণবিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। ইরানে বর্তমানে মসজিদ ও মেট্রো স্টেশনগুলোকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রতিশোধ হিসেবে ইরানও শুক্রবার থেকে ইসরাইলের একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার ফলে বেশ কয়েকজন হতাহত এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
রাজধানী তেহরানসহ বেশ কয়েকটি শহরে ইসরাইলি হামলায় রোববার(১৫ জুন) পর্যন্ত ইরানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ জনে পৌঁছেছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এপি’র এক প্রতিবেদন এতথ্য জানিয়েছে।
এদিকে, নতুন করে আরও হামলার শুরু করতে যাচ্ছে ইরান। এরই ধারাবাহিকতায় ইসরাইলিদের তাদের নিরাপত্তার জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ এলাকা’ ত্যাগ করতে বলেছে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী। ইরান নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে উল্লেখ করে দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভিতে সম্প্রচারিত একটি ভিডিও বিবৃতিতে ইসরাইলিদের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়।
সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল সাইয়্যাদ বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে সুরক্ষিত বাংকার বা আন্ডারগ্রাউন্ড শেল্টারও আর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না।’
এমআর//