গেল সোমবার (১৭ জুন) ইসরায়েলের হামলায় ইরানের রাজধানী তেহরানে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত কর্মকর্তাদের বাসভবন আক্রান্ত হয়েছে। একজন কর্মকর্তার বাড়িঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে হামলার সময় ওই কর্মকর্তা বাড়িতে না থাকায় প্রাণে বেঁচে গেছেন।
ভুক্তভোগী দূতাবাস কর্মকর্তা ওয়ালিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তার বাসা পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
তেহরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জর্ডান নামের একটি এলাকায় বসবাস করেন।
ওই এলাকায় ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে। সেইসব স্থাপনায় সোমবার ঘোষণা দিয়ে হামলা করেছে ইসরায়েল।
অবশ্য হামলার আগে বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়। এ কারণে প্রাণহানি কিছুটা কম হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক স্থাপনা।
ইরানে বাংলাদেশি দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ওয়ালিদ ইসলাম জানিয়েছেন, তাদের আশপাশে এখন আর কিছুই নেই। শুধু কূটনীতিকদের কয়েকটি বাড়ি টিকে আছে।
সোমবার দুপুরে তেহরানের তিন নম্বর জেলায় ইসরায়েলি সেনারা হামলার ঘোষণা দেয়। পরে সেখানকার বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বাংলাদেশি নাগরিকদের ওই এলাকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ঢাকা।
এরপর তেহরানে বাংলাদেশের দূতাবাস কমপ্লেক্স ছেড়ে যান সেখানকার তারা। বর্তমানে তাঁরা তেহরানের অন্য এলাকায় আছেন।
এদিকে ইসরায়েলি হামলার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাগরিকদের তেহরানের বাইরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল আলম সিদ্দিক বলেছেন, তেহরানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ব্যাপারে সরকার উদ্বিগ্ন। তাঁরা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেইসব বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশ দূতাবাসে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদেরকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা চলছে।
তেহরানে চার শর মতো বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। এখনো পর্যন্ত তাঁরা সবাই অক্ষত আছেন।
ইরানে টানা হামলা করছে ইসরায়েল। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে তেহরান।
এ অবস্থায় জীবন বাঁচাতে দলে দলে রাজধানী ছাড়ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। এ কারণে তেহরানের রাস্তায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে অনেক মানুষ গাড়িতে করে শহর ছাড়তে যাওয়ায় পাম্পগুলোতে জ্বালানি তেলের সংকট হয়েছে। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। তেল পাচ্ছেন না।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে তেহরান থেকে বের হতে বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন সেখানকার অনেক বাংলাদেশি।
তেহরানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা ওয়ালিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন অনেকেই ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছেন। তারা বাঁচানোর আকুতি করছেন।
তেহরানের বাইরেও কিছু শহরে হামলার হয়েছে। ফলে সেসব জায়গা থেকেও অনেকে যোগাযোগ করছেন। তারা বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য।
ওয়ালিদ ইসলাম আরো বলেন, বন্দর আব্বাসে হামলার হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতিও খারাপ। ওই এলাকা থেকেও অনেকে ফোন করছেন। কান্নাকাটি করছেন। এই আর্তনাদ আসলে সহ্য করা যায় না।
বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০ জন সম্প্রতি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তেহরানে গিয়েছেন।
ওয়ালিদ ইসলাম বলেছেন, মূলত তাঁরা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য সেখানে গেছেন।
তেহরানে যাওয়ার পর থেকে তাঁরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছিলেন। গেল শুক্রবার ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর তাঁদের হাসপাতাল এলাকায় অবস্থান করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
ওয়ালিদ ইসলাম বলেন, ‘এ সময় হাসপাতাল নিরাপদ হবে। এ কারণেই তারা এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু গত পরশু হাসপাতালেই আক্রমণ হয়েছে।’
এ ঘটনায় রোগীদের সবাই আতঙ্কিত আছেন। তাঁদেরকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বেড়াতে গিয়েও কেউ কেউ আটকা পড়েছেন। তেমনই একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক ইকরাম আর আজিজুর রহমান। তাঁর স্ত্রী একজন ইরানি নাগরিক। গত মে মাসে তাঁরা ইরানে যান। বাংলাদেশে ফেরার কথা ছিল ১৫ জুন।
বিবিসি বাংলাকে আজিজুর রহমান জানান, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় ১৫ তারিখে ফেরা সম্ভব হয়নি। কবে ফিরতে পারবেন, সেটাও বুঝতে পারছেন না।
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময় পড়াশোনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিসহ নানা কারণে অনেক বাংলাদেশি ইরানে গিয়েছেন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ইরানে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে ৪০০ জনের মতো তেহরানে রয়েছেন। সোমবার সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল আলম সিদ্দিক এই তথ্য জানিয়েছেন।
তারা যাতে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে ‘হটলাইন’ চালু করেছে তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাস। আরেকটি হটলাইন চালু করা হয়েছে ঢাকায়।
রুহুল আলম সিদ্দিক বলেছেন, প্রায় ১০০ জন বাংলাদেশি নাগরিক দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হটলাইনে যোগাযোগ করেছে। তারা নিরাপদ স্থানে যেতে চাইছে।
তাদের সঙ্গে দূতাবাসের ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
দূতাবাসের কর্মকর্তা ওয়ালিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আপাতত সবাইকে ভারামিনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের তেহরানের পাশে সাবেতে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ভারামিন শহরও তেহরানেই অবস্থিত। পরবর্তী সময়ে সেখানেও হামলার আশঙ্কা আছে। তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনা হতে পারে।
ওয়ালিদ ইসলাম বলেন, আপাতত তা সম্ভব নয়। কারণ ইরানে বিমান চলাচল বন্ধ। এক দিনের জন্যও যুদ্ধবিরতি হলেও সবাইকে ইরানের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করা হবে।
এমএ//