অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় দৈনন্দিন জীবনে আশেপাশে অনেক রকমের মানুষ থাকে। তবে আলাদা আলাদা মানুষ হওয়ার কারণে একেকজনের একেক রকমের অসুখও হয়ে থাকে। যার কারণে অনেকে তার সমস্যা নিয়ে চিন্তিতও থাকে। নাক দিয়ে রক্ত পরাও এক প্রকার অসুখ। তবে সেটা হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী অথবা ক্ষণস্থায়ী। সাধারণত নাক দিয়ে রক্ত পড়া (Epistaxis) পরিচিত সমস্যা হলেও অনেক ক্ষেত্রে এই সমস্যা মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বৈশ্বিক অন্যান্য গবেষণাপত্রগুলির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে এই সমস্যা একাধিক কারণে হতে পারে, তবে এর চিকিৎসা ও প্রতিকার সহজ।
বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে গবেষণা করে আসছে। জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল এর গবেষকদের মতে, নাক দিয়ে রক্ত পড়া কোন একক কারণে নয় বরং, একাধিক উপাদান একত্রে এই সমস্যা তৈরি করে। এই সমস্যা প্রাথমিকভাবে নাকের ভেতরের শ্লেষ্মা শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে হয় এবং পরবর্তীতে পরিবেশের কারণে রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জন্স হপকিন্স মেডিক্যাল স্কুলের ডাঃ জেমস ডি. হ্যারিস একজন নাক ও কান-বাহ্যগতিক বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, শুষ্ক আবহাওয়া, ঠাণ্ডা এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ চাপ একত্রে এই সমস্যাটির জন্ম দেয়। এবং রোগী যদি আগে থেকেই শ্বাসতন্ত্রের কোনও সমস্যা নিয়ে থাকে তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইএমও মেডিক্যাল সেন্টার (Emergency Medical Organization) এর এক সমীক্ষায় জানা গেছে, শিশুদের মধ্যে শুষ্ক আবহাওয়া ও ভাইরাল ইনফেকশন মূল কারণ হিসেবে দেখা গেছে। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, শর্করা এবং শিরা সংকোচনের সমস্যার কারণে এমনটি হতে পারে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণ -
সাধারণত নাকের ভিতরে ছোট রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হলে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার ঘটনা ঘটে। এর প্রধান কারণগুলো হলো-
শুকনো আবহাওয়া (ড্রাই এয়ার):
বিশেষ করে শীতকালে বা শুষ্ক পরিবেশে শ্লেষ্মা শুষ্ক হয়ে পড়ে, ফলে নাকের ভেতরের রক্তনালী ফেটে যেতে পারে। গরম এয়ার কন্ডিশনার বা হিটার ব্যবহারও এই সমস্যার বাড়তি কারণ।
নাকের ভিতরে আঘাত:
নাকের বাহ্যিক চাপ বা আঘাত যেমন -দুর্ঘটনা, সর্দি-কাশি বা অতিরিক্ত নাক পরিষ্কার করা, এর ফলে রক্তপাত হতে পারে।
অ্যালার্জি ও ইনফেকশন:
ঠাণ্ডা, ফ্লু, সাইনাস ইনফেকশন বা নাকের অ্যালার্জি থেকেও রক্ত পড়তে পারে। বিশেষ করে সাইনাস ইনফেকশন ও সর্দির সময় নাকের ভিতরে অতিরিক্ত আর্দ্রতা সৃষ্টি হয়, যা রক্তনালীগুলির ক্ষতি করতে পারে।
রক্তচাপ বা হরমোনের পরিবর্তন:
উচ্চ রক্তচাপ বা গর্ভাবস্থার মতো শারীরিক অবস্থায়ও নাক দিয়ে রক্ত পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এতে নাকের রক্তনালী ফেটে গিয়ে রক্ত পড়তে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
রক্ত পাতলা করার জন্য ব্যবহৃত ওষুধ যেমন - এসপিরিন, ওয়ারফারিন (অ্যান্টিকোঅ্যাগুলেন্টস) ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে রক্ত পড়তে পারে। এছাড়া অনেক সময় নাকের স্প্রে বা ডিকনজেস্ট্যান্টও শ্লেষ্মা শুষ্ক করে রক্তপাতের কারণ হতে পারে।
আবার অনেক সময় কোলাজেনের অভাব, রক্তের সমস্যা (যেমন হিমোফিলিয়া বা থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া) বা অটোইমিউন ডিজিজও নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণে হতে পারে।
নাক দিয়ে রক্ত পড়লে যা করবেন -
এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে:
নাক বন্ধ করা:
প্রথমে নাকের রক্ত বন্ধ করতে একটি সোজা অবস্থানে বসে নাকের দুই পাশের অংশ চেপে ধরে রাখুন। মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে নেবেন না, কারণ এতে রক্ত গলায় চলে যেতে পারে।
ঠাণ্ডা প্রয়োগ:
একটি ঠাণ্ডা কাপড় বা বরফের সেঁক নাকের ওপর রাখলে রক্তপাত স্থগিত হতে পারে। ঠাণ্ডা চাপ দেয়ার ফলে রক্তনালী সংকুচিত হয়, যা রক্ত পড়া বন্ধ করতে সাহায্য করে।
স্যালাইন স্প্রে:
শুষ্কতার কারণে নাকের শ্লেষ্মা শুষ্ক হয়ে গেলে, স্যালাইন স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রক্ত পড়া দীর্ঘ সময় ধরে চললে (১৫ মিনিট বা তার বেশি) চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিশেষ করে যদি এটি একাধিকবার ঘটে থাকে তাহলে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ -
যদি নাক দিয়ে রক্ত পড়া বেশ সময় ধরে চলে অথবা পুনরায় ঘটতে থাকে, তবে এটি একটি চিকিৎসাগত সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর, তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবেন। যেমন:
কটন প্যাকিং বা ইন্টারনাল প্যাকিং:
নাকের ভিতরে কটন বা গজ ব্যবহার করে রক্ত আটকানো যেতে পারে।
লেজার চিকিৎসা বা কেমোথেরাপি:
যদি রক্তনালী খোলার কারণে বারবার রক্ত পড়ছে, তবে লেজার বা রেডিওফ্রিকোয়েন্সি (RF) থেরাপি ব্যবহৃত হতে পারে।
সার্জারি:
কখনো কখনো অস্ত্রোপচারও প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষত যদি রক্তনালী মেরামতের জন্য কোনও সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা -
আর্দ্রতা বজায় রাখুন:
শীতকালে আর্দ্রতা বজায় রাখতে ঘরোয়া আর্দ্রifier ব্যবহার করুন।
নাকের শ্লেষ্মা রক্ষা:
নাক পরিষ্কার করার সময় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করবেন না, এবং নাক চিপে ধরবেন না।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
যদি উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।
যদি পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে তাহলে সময়মত চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া জরুরি। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে সতর্ক থাকা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
এসকে//