আধুনিক ও স্মার্ট যুগে পণ্য পরিহনে আধুনিকতার ছোয়া আসলেও এখনো কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর চরাঞ্চলে পণ্য পরিবহনে ভরসা ঘোড়ার গাড়ি।
মধ্যপ্রাচ্য অথবা মরুভূমি অঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থায় উটের অগ্রণী ভূমিকা থাকলেও কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় পণ্য পরিবহনে যুগের পর যুগ ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি। দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন শতাধিক চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া করা হচ্ছে ঘোড়ার গাড়িতে।
যুগের পর যুগ ধরলা, বারোমাসিয়া ও নীলকমলসহ বিভিন্ন নদ-নদীর চরাঞ্চলগুলোতে এক সময় নিত্যপণ্য পরিবহনে গরু বা মহিষের গাড়ি ব্যবহার করা হতো। এখন কালের পরিক্রমায় বদলে যেতে শুরু করেছে সেই চিত্র। এখন প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে পণ্য পরিবহনে একমাত্র বাহন হিসেবেই চোখে পড়ে ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িই চরাঞ্চলের মানুষের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিনে নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোরকমন্ডল, চরগোরকমন্ডল, পশ্চিম ফুলমতি দুর্গম চরগুলোতে সহজেই চোখে পড়ে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব গাড়ী। ধু ধু বালুময় চরের ওপর দিয়ে মালামাল নিয়ে ছুটে চলেছে শত শত ঘোড়ার গাড়ি। শুধুই নাওডাঙ্গা ইউনিয়নে নয় উপজেলার ৬ ইউনিয়নের প্রায় দেড় থেকে ২ হাজার ঘোড়ার গাড়ি চালক পণ্য পরিবহন করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
চরাঞ্চলের ব্যবসায়ী ও কৃষকরা জানায়, এলাকা জুড়ে চরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য এবং ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহনে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। এসব চরাঞ্চলে যান্ত্রিক কোনো যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় ঘোড়ার গাড়িই পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি গাড়িতে ১৫ থেকে ২০ মণ পণ্য অনায়াশেই পরিবহন করা যায়।
পশ্চিমফুলমতি কলাবাগান এলাকার ঘোড়ার গাড়ি চালক শহিদুল ইসলাম মিয়া ও চরগোরকমন্ডল সামেশ আলী জানান, তারা প্রত্যেকেই ৮ বছর ধরে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তারা জানান ওই গ্রামসহ নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন প্রায় দুই শতাধিক ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। প্রত্যেক ঘোড়ার চালক দিনে কমপক্ষে ৮০০ ও সর্বোচ্চ ১৫০০ এমনকি ২ হাজার টাকা আয় করেন।
দিনের ঘোড়ার খাবার বাবদ খরচ হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। একটি ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করতে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাগে।
চরগোরকমন্ডল এলাকার ঘোড়ার গাড়ি চালক আলামিন, রমজান আলী ও একরামুল হক জানান, আগে গরুর গাড়ি পণ্য পরিবহন করতো। গরুর গাড়িতে দুটি গরু বা মহিষ লাগায় খরচও বেশি। অথচ ঘোড়ার গাড়িতে একটি ঘোড়া হলেই হয়। এতে খরচও অনেক কম পড়ে। চরাঞ্চলে বালু বেশি থাকায় মালামাল পরিবহনে অন্য কোনো যানবাহন চলাচল সম্ভব হয় না। খুব সহজেই ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষসহ মালামাল আনা নেওয়া করা হয়। এতে সারা আমাদের দিনে ৮০০, ৯০০ এমনকি হাজার টাকা আয়। তা দিয়ে আমাদের সংসারের ব্যয়বহন করা হয়।
বালারহাট বাজারে কাঠ ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ জানান, ঘোড়ার গাড়ি সব এখানেই যেতে পারে। যেমন চরাঞ্চল ও দোলায় ট্রাক্টর ও ভ্যান গাড়ি যেতে পারে না। সেক্ষেত্রে ঘোড়ার গাড়ি পণ্য পরিবহন সব জায়গায় গিয়ে সব ধরনের মালামাল বহন করা যাচ্ছে। এতে খরচ একটু বেশি হলেও সুবিধা আছে অনেক।

বালারহাট বাজারের তানিয়া স্টোরের মালিক আবু তালেব জানান, বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি থাকায় পণ্য পরিবহন সহজ হলেও শুকনো মৌসুমে বালুর গভীরতা বেশি থাকায় ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। সেক্ষেত্রে ঘোড়ার গাড়ি খুব সহজেই সেগুলো পরিবহন করতে পাচ্ছে।
চরগোরকমন্ডল ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আয়াজ উদ্দিন জানান, তার গ্রামে প্রায় শতাধিক ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। এ সব গাড়ি পণ্য পরিবহন বহনে বিশেষ ভুমিকা রাখছে। প্রতিদিনেই প্রয়োজনীয় পণ্য আনন্দ বাজার থেকে বালারহাট বাজারে নিয়ে যাওয়া আসা করে। বিশেষ করে চরাঞ্চলের শতশত মানুষ ঘোড়ার গাড়িতে বিভিন্ন মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
নাওডাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজ অধ্যক্ষ আব্দুল হানিফ সরকার, এক সময় ঘোড়ার পিঠে রাজা বাদশারা চড়তো। মুলতো ঘোড়া তাদের চলাচলের একমাত্র বাহন ছিল। সেই প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর ঘোড়া পণ্য পরিবহনে ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। বর্তমান যুগে পণ্য পরিবহনে আধুনিকতা আসলেও ঘোড়া গাড়ি বিশেষ করে চরাঞ্চলসহ সব বিভিন্ন এলাকায় পন্য পরিবহনের একমাত্র বাহন হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। শুধু চরাঞ্চলে নয় সব খানে পরিবেশ বান্ধব ঘোড়ার গাড়িতে মানুষ পণ্য পরিবহনসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ইদানিং ঘোড়ার গাড়ি বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
আই/এ