আর্কাইভ থেকে করোনা ভাইরাস

কোভিডে বিপর্যস্ত ভারতে বাংলাদেশি রোগীরা দিশেহারা

কোভিডে বিপর্যস্ত ভারতে বাংলাদেশি রোগীরা দিশেহারা

কোভিডে মৃত মায়ের মরদেহ নিয়ে কীভাবে দ্রুত বাংলাদেশে ফিরবে, মর্যাদার সঙ্গে মাকে দাফন করতে পারবে তা নিয়ে উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছে নাহিদ নাসের তৃণা, তার দুই বোন, চাচাতো ভাই এবং শোকে কাতর বাবা।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে অনাপত্তিপত্রের (এনওসি) জন্য আবেদন করেছে তারা। কিন্তু রোববার বিকাল পর্যন্ত তা তাদের কাছে যায়নি। শুধু মায়ের মরদেহের ছাড়পত্র হাতে পাওয়া গেছে। শুক্রবার থেকেই হাসপাতালের হিমঘরে মৃত মা।

দিল্লি থেকে টেলিফোনে বিবিসিকে ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তৃণা জানান, আমাদের মনের অবস্থা কেমন তা বলে বোঝাতে পারবো না।

ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তা

গুলশান আক্তারের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না তার স্বামী এবং সন্তানেরা। শোকের চেয়ে মরদেহ নিয়ে বাংলাদেশে ফেরা এবং তার দাফন নিয়ে শোকের চেয়ে উদ্বেগই বেশি পুরো পরিবারের।

কখন দেশে যাওয়া যাবে?

তৃণা জানান, বিমান নেই, ফলে কিভাবে এতদূর মায়ের মরদেহ নিয়ে যাবো? বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হলে কিভাবে তা সম্ভব হবে? মায়ের দাফন কোথায় কিভাবে হবে এসব চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে আছে সবার।

শুধু গুলশান আক্তারই নয়, একে একে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন সাত সদস্যের পরিবারের সবাই। উপসর্গ না থাকলেও সবাই যে নেগেটিভ হয়েছে রোববার পর্যন্ত সেই পরীক্ষার ফলাফল পায়নি তারা।

গেল ২৬ মার্চ নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি বদলাতে দিল্লিতে যান গুলশান আক্তার। সঙ্গে ছিলেন স্বামী, তিন মেয়ে, তাদের চাচাতো ভাই এবং বাসার গৃহকর্মী। দিল্লির উপকণ্ঠে ফিরোজাবাদ এলাকায় হাসপাতালের কাছে একটি বাসা ভাড়া নেয় তারা।

তখন দিল্লির কোভিড পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে শুরু করেছে।

তৃণা বলেন, মায়ের ডায়ালাইসিস চলছিল সপ্তাহে তিনদিন। শহরের কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের খবর শুনছিলাম। চিন্তা ঢুকেছিল এখন মায়ের চিকিৎসা ঠিকমত কি হবে?

তিনি আরো জানান, আমরা মনে করিনা চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি হয়েছে। তবে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মা প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়েছিলেন। তাকে আইসোলেশনে রাখা হয়। হিন্দি বা ইংরেজি বলতে পারতেন না। আমাদের সঙ্গে দেখাও হতো না। আমার মনে হয় ওই চাপ নিতে পারেননি তিনি।

মাঝে মধ্যে গুলশান আরা পরিবারকে বলতেন, মৃত্যুর পর তাকে যেন নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। আমরা কি তা পারবো জানিনা, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তৃণা।

এনওসি পেলেও ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের আসতে হচ্ছে বেনাপোল স্থল সীমান্ত দিয়ে। ঢোকার পর সেখানে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। সেই চিন্তায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তৃণা, তার ভাই-বোন এবং বাবা।

অনেকে আটকা পড়েছে

তৃণার পরিবারের মত কম-বেশি একই সংকটে পড়েছে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বহু বাংলাদেশি। চেন্নাইতে চিকিৎসা করতে গিয়ে একইভাবে আটকা পড়েছেন মোহাম্মদ কামরুজ্জামান এবং তার স্ত্রী। বললেন, তার শরীরের যে অবস্থা তাতে স্থলপথে ফেলা সম্ভব নয়। ফলে এনওসির জন্য আবেদনও করেননি।

বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের পর সেখানে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকা নিয়েও উদ্বিগ্ন তিনি। বাংলাদেশে না ফিরে চেন্নাই থেকে দুবাই গিয়ে কিছুদিন থাকার কথা ভাবলেও ফ্লাইট বন্ধ।

বিবিসিকে চেন্নাই থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, হোটেলে খাঁচাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছি।

কামরুজ্জামান জানালেন, যে হাসপাতালে তার চিকিৎসা হচ্ছিল সেখানেই শনিবার ক্যানসারে মারা গেছে একজন বাংলাদেশী।

মরদেহ দেশে নিয়ে যাওয়া নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে সঙ্গে আসা পরিবারের সদস্যরা। সরকারের উচিৎ দ্রুত বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে সঙ্কটে পড়া মানুষকে নেওয়ার ব্যবস্থা করা।

এনওসির জন্য শত শত আবেদন

এনওসি’র জন্য দিল্লিতে হাই-কমিশন ছাড়াও মুম্বাই এবং কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশনেও প্রতিদিন শত শত আবেদনপত্র পড়ছে। সবচেয়ে বেশি আবেদন হচ্ছে কলকাতায় বাংলাদেশে ডেপুটি হাই কমিশনে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে সেখানকার একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন আমাদের এখানে ৩০০ থেকে ৫০০ আবেদন পড়ছে।

কিন্তু এনওসি দেওয়ার সময় বেনাপোল সীমান্তের ওপাশে কোয়ারেন্টিন সুবিধার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। যাদের ভিসার মেয়াদ যাদের শেষ হয়ে যাওয়ার পথে বা মারা যাচ্ছে তাদের এবং স্বজনদের আবেদনপত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

এরপরও, সীমান্ত বন্ধ হওয়ার পর গেল ১৫ দিনে কলকাতা ডেপুটি হাই-কমিশন থেকেই প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফেরার জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

তবে কলকাতার ওই কর্মকর্তা জানান, বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গতকাল রোববার থেকে ঈদ পর্যন্ত আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দেশে ফেরার এনওসি দেওয়া বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ভাইরাস নিয়ে ফিরছে অনেকে

শনিবার বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারত থেকে ফেরা দুইজনের শরীরে নিশ্চিতভাবে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে সরকারের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

গেল ১৫ দিনে ভারত ফেরত ২৫ জন কোভিড পজিটিভ হয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন যশোরের আড়াইশ বেড হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: দিলিপ কুমার রায়। এখন হাসপাতালটিতে ১৭ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে।

 

এসএন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন কোভিডে | বিপর্যস্ত | ভারতে | বাংলাদেশি | রোগীরা | দিশেহারা