স্বাধীনতার পর দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন মা এবং ৫০০ নবজাতকের মৃত্যু হতো। বর্তমানে তা কমে এসেছে। এখন প্রতি লাখে ১৬৪ মায়ের মৃত্যু হয়। তবে এটিকে আরও কমিয়ে ১০০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে জানিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোববার (৪ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে জহুর হোসেন মিলনায়তনে অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়।
আলোচকরা বলেন, মাতৃমৃত্যু প্রধানত দুটি কারণে হয়। রক্তক্ষরণ ও খিচুনি। এটি হয় বাড়িতে অদক্ষ দাইয়ের মাধ্যমে ডেলিভারির কারণে। এটা মোকাবিলায় ডেলিভারি রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু রোগীরা এমন অবস্থায় হাসপাতালে আসেন, যখন আর কিছুই করার থাকে না। মাতৃমৃত্যু রোধে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মায়েদের হাসপাতালে আনা। তাদের হাসপাতালে আনতে পারলে মাতৃমৃত্যু সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান হয়ে যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গ্রামে ডেলিভারির জন্য সরকারিভাবে মিউওয়াইফ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসকরা নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাগুলো কীভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি বেগম বলেন, বর্তমানে মাতৃমৃত্যু লাখে ১৬৪ জনে নেমে এসেছে। তবে এটা ৭০ জনে নামিয়ে আনতে হবে। এখানে প্রধান প্রতিবন্ধকতা অপ্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি। এখনও শতকরা ৫০ ভাগ ডেলিভারি বাড়িতে অদক্ষ দাইয়ের মাধ্যমে হয়। আমরা সেটাকে প্রাতিষ্ঠানিক করতে চাই। যেন মাতৃ ও শিশুমৃত্যু না ঘটে। তিনি আরও বলেন, গর্ভবতী নারীর সেবায় প্রতিটি স্তরে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তবুও অনেকে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে যান না। গর্ভাবস্থায় মাত্র ৪৭ শতাংশ মা চারবার চিকিৎসকের কাছে আসেন। মায়েদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে কয়েকটি সূচক রয়েছে। এরমধ্যে বর্তমানে ৬০ শতাংশ স্বামী-স্ত্রী কনডম ব্যবহার করেন। এটাকে আরও বাড়াতে হবে। আমাদের বর্তমান ফার্টিলিটি রেট ২ দশমিক ২ শতাংশ এটা ২ এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুল আরা হক বলেন, মাতৃমৃত্যু রোধে সব থেকে জরুরি নারীকে মানুষ হিসাবে সম্মান করা। নারীর মৃত্যুর কারণ, সমাজে তাদের জীবনের মূল্য নেই।
অনুষ্ঠানে ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি বেগম, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা, অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম, অধ্যাপক ডা. পারভিন ফাতেমা, অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. কোহিনুর বেগম, অধ্যাপক ডা. সেহেরিন ফরহাদ সিদ্দিকা, অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান এবং অধ্যাপক ডা. এসকে জিন্নাত আরা নাসরিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ওজিএসবি বাংলাদেশের স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যার বিশেষজ্ঞদের একটি অলাভজনক সংগঠন। নারীশিক্ষা, সেবা, শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য নারীর প্রতি সামাজিক দায়িত্ব অর্থাৎ মেয়েদের সকল প্রকার সেবামূলক কাজ ওজিএসবি করে থাকে। নারী স্বাস্থের উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে এর ১৮টি শাখা আছে এবং এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৬০০। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ওজিএসবি যুদ্ধে আহত ও নির্যাতিত নারীদের সেবা ও সহযোগিতায় সরকারকে এগিয়ে আসার জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়েছিল।
বর্তমানে এই সংগঠনটি বিভিন্ন দেশি বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়ার পিছনে এই সংগঠনটির ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। বাংলাদেশে মা ও নারীস্বাস্থ্য বিষয়ে সার্বিক ও সঠিক চিকিৎসা সেবা এবং সচেতনতা তৈরীতে সংগঠনটি বিভিন্ন সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন এর আয়োজন করে থাকে।