আজ চালু হয়েছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল পথের একাংশ। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় আরও পাঁচটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। দুইটির কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। একটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছে। বাকি দুইটি কবে নাগাদ নির্মাণ পর্যায়ে আসবে, তা নিশ্চিত নয়। এ হিসাবে পরিকল্পনা থাকলেও ২০৩০ সালের মধ্যে সব কয়টি মেট্রোরেল চালুর সম্ভাবনা কম।
দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটর দীর্ঘ মেট্রোরেল লাইন (এমআরটি-৬) প্রকল্প ২০১২ সালে সরকারের অনুমোদন পায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করা হয়েছে। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুনে দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও অংশ এবং ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি-৬ চালু হওয়ার কথা ছিল। তবে সরকারের চেষ্টা ছিল 'আর্লি কমিশনিং'-এর মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত এবং ২০২২ সালের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা।
তবে হলি আর্টিসানে সন্ত্রাসী হামলায় মেট্রোরেলের নির্মাণে সংশ্নিষ্ট সাত জাপানি নাগরিকের মৃত্যু এবং করোনা মহামারিতে কাজের গতি কমায় 'আর্লি কমিশনিং'-এর লক্ষ্য পূরণ হয়নি। প্রকল্প মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর করা হয়েছে। ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।
ঢাকার যানজট নিরসনে ২০০৫ সালে প্রণীত হয় কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)। এই পরিকল্পনায় রাজধানীর যানজট নিরসনে তিনটি মেট্রোরেল এবং তিনটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণের সুপারিশ করা হয় ২০২৪ সালের মধ্যে। কিন্তু তা মানা হয়নি। নির্মাণ করা হয় প্রাইভেটকারকে উৎসাহিত করা ফ্লাইওভার। এতে যানজট আরও বেড়েছে। এসটিপি সংশোধন করে ২০১৫ সালে প্রণীত হয় আরএসটিপি। এ পরিকল্পনায় রাজধানীতে ছয়টি মেট্রোরেল লাইন এবং দুটি বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে ২০৩৫ সালের মধ্যে। সময়বদ্ধ পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে সব ক'টি মেট্রোরেল নির্মাণ করতে চায় সরকার। ছয়টি রুটে প্রতিদিন ৫০ লাখ যাত্রী হবে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে।
বিমানবন্দর স্টেশন থেকে কমলাপুর এবং নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি-১ লাইনের ডিপোর পূর্তকাজে গত মাসে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। আর এর মাধ্যমে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ দেবে। বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।
এমআরটি-১-এর বিমানবন্দর-কমলাপুর স্টেশন অংশের ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার নির্মিত হবে মাটির নিচে। এটিই হবে দেশের প্রথম পাতাল রেল। এই পথে স্টেশন থাকবে ১২টি। সবগুলো হবে মাটির নিচে। স্টেশন হবে বিমানবন্দর, টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, নর্দ্দা, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, আফতাবনগর, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ এবং কমলাপুর।
টানেল বোরিং মেশিনের (টিবিএম) মাধ্যমে কমলাপুর ও বিমানবন্দর দুই দিক থেকে মাটির নিচে রেলপথ নির্মাণ করা হবে। প্রতিদিন ১০ মিটার করে রেলপথ নির্মাণ করতে পারবে টিবিএম। মাটির ২৫ থেকে ৩০ মিটার গভীরে সুড়ঙ্গ খনন করা হবে। কংক্রিট স্লাব বসিয়ে তৈরি করা হবে টিউব। তার ভেতরে থাকবে ডাবল রেললাইন। তবে স্টেশনগুলো তৈরি করা হবে ওপেন কাট পদ্ধতিতে। ওপর থেকে মাটি খুঁড়ে স্টেশন নির্মাণের পর, তা আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে। স্টেশনে যেতে থাকবে সিঁড়ি।
এমআরটি-১ লাইনের আরেকটি অংশ নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত। নতুন বাজারে থাকবে দুই লাইনের ইন্টারচেইঞ্জ। ১১ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অংশ হবে এমআরটি-৬-এর মতো উড়াল। অর্থাৎ পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কের ওপর নির্মিত হবে ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ)। ৯টি স্টেশনও এলিভেটেড। স্টেশন হবে নতুন বাজার, নর্দ্দা, জোয়ার সাহারা, বোয়ালিয়া, মস্তুল, শেখ হাসিনা স্টেডিয়াম, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল পূর্ব, পূর্বাচল টার্মিনাল, পিতলগঞ্জ ডিপো।
এমআরটি-১ প্রকল্প ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৬ সালে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। এমআরটি-১ লাইনের ডিপো নির্মাণে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৯৪০ কোটি টাকায় ৯২ দশমিক ৯৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ১২টি ভাগে (প্যাকেজে) এই মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ করা হবে। সাতটি প্যাকেজের প্রাক-যোগ্যতার আবেদন আহ্বান করা হয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী হয়ে ভাটারা পর্যন্ত দীর্ঘ এমআরটি-৫ নর্দান লাইন নির্মিত হবে। এই পথের সাড়ে ১৩ কিলোমিটার নির্মিত হবে মাটির নিচে। এটিই হবে ঢাকার প্রথম পূর্ব-পশ্চিমমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা। স্টেশনগুলো হবে হেমায়েতপুর, বলিয়ারপুর, বিলামালিয়া, আমিনবাজার, গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান-২, নতুনবাজার, ভাটারা।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে অনুমোদিত ৪১ হাজার ২২৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পের ডিপোর ভূমির কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এই প্রকল্পে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা ঋণ দেবে জাপান। বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা জোগান দেবে সরকার। অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমআরটি-৫ নর্দান লাইনে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা ও প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৬৮ শতাংশ এগিয়েছে। ডিপোর জন্য হেমায়েতপুরে ৯৩৫ কোটি টাকায় ৯৯ দশমিক ২৫ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ডিপোর ভূমি উন্নয়নে প্যাকেজ-১-এর দরপত্র গত অক্টোবরে রয়েছে। চারটি প্যাকেজের দরপত্র দলিল তৈরি করা হচ্ছে। তিনটি প্যাকেজের প্রাক-যোগ্যতার আবেদন আহ্বান করা হয়েছে।
পূর্ব-পশ্চিমমুখী যোগাযোগ ঘাটতি দূর করতে গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত ১২ দশমিক ৮ কিলোমিটার পাতাল এবং আফতাবনগর থেকে ৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার অর্থাৎ মোট ১৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি-৫ সাউদার্ন লাইনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছে। এই পথে ১১টি পাতাল এবং চারটি উড়ালসহ মোট ১৫টি স্টেশন থাববে। স্টেশন হবে গাবতলী, টেকনিক্যাল, শ্যামলী, কলেজ গেইট, আসাদ গেইট, রাসেল স্কয়ার, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল, আফতাবনগর, আফতাবনগর সেন্টার, আফতাবনগর পূর্ব, নাছিরাবাদ ও দাশেরকান্দি।
গাবতলী থেকে ঢাকা উদ্যান, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, নিউমার্কেট, আজিমপুর, পলাশী, গুলিস্তান, মতিঝিল, কমলাপুর, মাণ্ডা, সাইনবোর্ড হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এমআরটি-২ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর একটি শাখা লাইন যাবে গোলাপশাহ মাজার থেকে পুরান ঢাকার সদরঘাট পর্যন্ত। আগে পরিকল্পনা ছিল, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে এমআরটি-২ নির্মাণ করা হবে। তবে পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে উন্নয়ন সহযোগীর খোঁজ চলছে। কমলাপুর থেকে সাইনবোর্ড হয়ে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত এমআরটি-৪ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে। তবে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত হওয়ায় এ প্রকল্পটি নাও হতে পারে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, মিরপুর-১০ নম্বরে মিলবে এমআরটি-৬ এবং এমআরটি-৫ নর্দান। কারওয়ান বাজারে মিলবে এমআরটি-৬ এবং এমআরটি-৫ সাউদার্ন। কমলাপুরে মিলবে এমআরটি-৬, এমআরটি-১ এবং এমআরটি-২। এখান থেকে শুরু হবে এমআরটি-৪। ২০৩৫ সালের পর এমআরটি-৬ দিয়াবাড়ী থেকে সাভারের বাইপাইল পর্যন্ত বর্ধিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এমআরটি-৫ লাইনটিও হেমায়েতপুর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত বর্ধিত করার বিষয়টি মহাপরিকল্পনায় রয়েছে। এমআরটি-১ বিমানবন্দর থেকে যাবে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত।