মেয়েটির বয়স তখন কেবল উনিশ। সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন শশধর মুখার্জীর সাথে। মুখার্জী তখন শহীদ (১৯৪৮) চলচ্চিত্রটি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি মেয়েটির গান শুনে 'বেশি চিকন গলা, এমন কণ্ঠ প্লে-ব্যাকের জন্য নয়' বলে বাতিল করে দিলেন। বিরক্ত রাগান্বিত হায়দার বলে বসলেন, 'একদিন পরিচালকেরা এই মেয়ের পায়ে পড়ে তাকে তাদের চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা করবে'। সেদিন কে জানত, এই ভবিষ্যৎবাণী অতি দ্রুতই সত্য হতে চলেছে?
মেয়েটি আর কেউ নন, ভারতের গানের পাখি লতা মঙ্গেশকর। গানের সুরে কয়েক দশক জুড়ে তার বিজয়ী বিচরণে বিমোহিত হয়েছে বিশ্ব।
এই কালজয়ী সংগীত শিল্পী আজ রোববার চলে গেলেন না–ফেরার দেশে। রেখে গেছেন তাঁর অন্যন্য সৃষ্টি।
কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছিলেন লতা। হিন্দি, মারাঠি, বাংলাসহ ৩৬টিরও বেশি ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় তাঁর গাওয়া অগণিত ক্লাসিকাল,গজল, ভজন, আধুনিক ও সিনেমার গান আজও সমান জনপ্রিয়।
‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’, ‘আকাশপ্রদীপ জ্বেলে’সহ আরও অনেক বিখ্যাত বাংলা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
আমি যে কে তোমার, আকাশ প্রদীপ জ্বলে, কি লিখি তোমায়, কেন কিছু কথা বলো না, আমারো তো সাধ ছিল, নিঝুম সন্ধ্যায় শ্রান্ত পাখিরা, ভালোবাসার আগুন জ্বেলে, বাঁশি কেনো গায়, চঞ্চলা মন আনমনা হয়, সাত ভাই চম্পা জাগোরো, না যেওনা রজনী এখনো বাকি, ওগো আর কিছুতো নয়, প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, চন্দ্ৰ যে তুই, রঙ্গীলা বাশিতে, ও মোর ময়না গো, কেন যে কাঁদাও, যদিও রজনী পোহালো সজনীসহ নানা কালজয়ী গান গেয়েছেন তিনি।
অনিল বিশ্বাস, এসডি বর্মন, সলিল চৌধুরীর মতো সংগীত পরিচালকদের পছন্দের গায়িকা ছিলেন লতা, অনেকেই হয়ত জানেন না আরডি বর্মনের কেরিয়ারের প্রথম ও শেষ গানটি লতার কণ্ঠে রেকর্ড করা।
নতুন শতাব্দীতে গানের জগত থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন লতা, তবুও ‘বীর জারা’, ‘রং দে বসান্তি’র মতো ছবির অ্যালবামের শোভা বাড়িয়েছে তাঁর সুমধুর কণ্ঠ। ২০১৯ সালে ভারতীয় আর্মিকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেন লতা, রেকর্ড করেন ‘তেরি মিট্টি কি সওগন্ধ’, এটিই লতা মঙ্গেশকরের রেকর্ড করা শেষ গান।
লতা মঙ্গেশকরের বিখ্যাত গানের তালিকা অগুনতি, ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’, ‘লাগ জা গলে, ‘চলতে চলতে’, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’- এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়।
লতা মঙ্গেশকর তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৪২ সালে, মারাঠি গান গেয়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম হিন্দি সিনেমার জন্য গান করেন। বসন্ত জোগলেকরের ‘আপ কি সেবা মে’ ছবিতে তিনি ‘পা লাগু কার জোরি’ গানটি গেয়েছিলেন। দুই বছর পর সুরকার গুলাম হায়দার তাঁকে প্রথম বড় সুযোগ দেন। ‘মজবুর’ ছবিতে ‘দিল মেরা তোরা’ গানটির পর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ছোট বোন আশা ভোষলের আগে ছিল লতা মঙ্গেশকর নাম। লতা গেয়েছেন প্রায় সাড়ে সাত হাজার গান।
দশকের পর দশক ধরে মোহিত ছিল তাঁর জাদুমাখা কণ্ঠ। তিনি ভারতের ‘নাইটএঙ্গেল’, ‘সুরের সরস্বতী’। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৯ সালে, তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। ২০০১ সালে দেশের সর্বোচ্চ অসমারিক নাগরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করা হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরকে। ২০০৭ সালে ফ্রান্স তাদের দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার (অফিসার অফ দি লেজিয়ান অফ অনার) দিয়ে সম্মানিত করে লতা মঙ্গেশকরকে।
তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ রয়েছে তিনটি জাতীয় পুরস্কার, বারোটি বাঙালি ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন পুরস্কার এবং চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। শেষে অবশ্য তিনি আর ফিল্ম ফেয়ার নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তার মতে, নতুনদের জায়গা করে দেয়া দরকার।
আক্ষরিক অর্থেই তিনি সুরের সরস্বতী। সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে এভাবে চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন তিনি।
তাসনিয়া রহমান