আর্কাইভ থেকে দেশজুড়ে

মাত্র অর্ধ যুগেই উন্নত জীবনের সান্নিধ্যে দাসিয়ারছড়াবাসী

মাত্র অর্ধ যুগেই উন্নত জীবনের সান্নিধ্যে দাসিয়ারছড়াবাসী

এক সময় নাগরিক হওয়ার কোনো সুযোগসুবিধাই ছিল না ছিটমহল বাসিন্দাদের। র্দীঘ ৬৮ টি বছর অন্ধকারেই ছিল ছিটমহলের বাসিন্দারা। এক কথাই বন্দিদশায় জীবন-কাঁটতো তাদের। ছিল না স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন। ছিল না চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থ। আধুনিক ঘরবাড়ি তো দূরের কথা চলাচলের কোনো রাস্তাঘাটই ছিল না। নদী, খাল, ডোবা এমনকি জমির আইলের ওপর দিয়ে মানুষজন কোনোমতে যাতায়াত করত। 

চুরি চাপটা করেই পরিচয় গোপন রেখে কিছু বাসিন্দা বাংলাদেশের বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে পড়াশুনা করেছে। কিছু মানুষ পরিচয় গোপন করে ভয় ভয় করে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা নিয়েছেন। এভাবেই চলতো তাদের কষ্টের জীবন।

বাংলাদেশ ভূখন্ড অংশ হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ৬৮ বছর অন্ধকারে থাকা বাসিন্দারা স্বাভাবিক নাগরিক জীবন ফিরে পেয়েছেন। র্দীঘ ছয় বছরে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার মানুষের জীবন উন্নয়ণের সাগরে ভাসছে। বদলে গেছে প্রতিটি মানুষের জীবন। ছিটমহল এখন শুধুই ইতিহাস ও অতীত স্মৃতি। 
সপ্তমতম বর্ষে পর্দাপনে বিলুপ্ত ছিটমহলে নানা অনুষ্ঠান করার কথা থাকলেও চলমান কঠোর বিধিনিষেধের কারণে এবারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতী প্রজ্জ্বলন শেষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পন করা বলে জানান সাবেক ছিটমহল আন্দোলনের নেতারা। 

বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের যে ১১১টি ছিটমহলের সবচেয়ে বড় এবং আয়তন ৬ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ হেড কাউন্টিং ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে এখানে ১ হাজার ৩৬৪ টি পরিবারের ৬ হাজার ৫২৯ জন মানুষের বসবাস।

বিলুপ্ত ছিটমহলে গিয়ে দেখা গেছে. প্রতিটি গ্রামের অলিগলিতে এখন প্রশাস্ত পাকা রাস্তা। প্রতিটি ঘরে ঘওে বিদ্যুৎ। সুদৃশ্য মসজিদ-মন্দির, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ, ডিজিটাল সেন্টার, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা হয়েছে। বর্তমান সরকারের নানারকম উন্নয়নমূলক উদ্যোগে বদলে গেছে এক নতুন জনপদ দাসিয়ারছড়া।

উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানিয়েছে, ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি সরকারি দাখিল মাদ্রাসা, দুটি কলেজ, ডিজিটাল আইসিটি ট্রেনিং সেন্টার, ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে কালীর হাটে কমিউনিটি রিসোর্স সেন্টার, ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচটি মসজিদ, ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি মন্দির, ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০ মিটারের একটি ব্রিজ, ৭টি বক্স কালভার্ট, ৩৫টি ইউড্রেন, ১টি কবরস্থান, শ্মশানঘাট ২টি, টিউবওয়েল ৩৮৪টি, কাঁচাপাকা ল্যাট্রিন ১ হাজার ১৫০টি স্থাপন করা হয়েছে। 

এ ছাড়া ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে হতদরিদ্র পরিবারের ১০টি বসতবাড়ি নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক, শতভাগ বিদ্যুতের সংযোগ, দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ। ইউনিসেফের অর্থায়নে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি স্থাপন করেছে ১৫টি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। এ ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ১৪ টি মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র। সেখানকার বাসিন্দাদের দেয়া হয়েছে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও স্মার্টকার্ড।

দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নিতে চালু করা হয়েছে নানারকম উদ্যোগ। তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে সেখানে ডি-সেট সেন্টার চালু করেছে আইসিটি বিভাগ। অনলাইনে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবা দেয়া হচ্ছে। করা যাচ্ছে ভিসা আবেদনও। এমনকি মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থাও চালু হয়েছে সেখানে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বেকার যুব ও যুব মহিলাদের দেওয়া হয়েছে নানা পেশায় প্রশিক্ষণ। 

শিক্ষার্থী আতাউর রহমান বলেন,আগে আমাদের ভাইবোনেরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মিথ্যা ঠিকানা দিয়া পড়ালেখা করছে। এখন আমরা আর মিথ্যা ঠিকানা দিই না। বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে আমি রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখ করছি। সকল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। আমাদের ভাই-বোনসহ সকল শিক্ষার্থী বই ও উপবৃত্তি সব কিছুই পাই। আমরা এই সরকারের প্রতি চিরকৃজ্ঞ।

দাসিয়ারছড়া সমন্বয়পাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হরি প্রসাদ সেন জানান, ‘আমরা স্কুল-কলেজে এখনও বিল বেতন পাইনি। পাঁচ বছর থেকেই বিনা বেতনে চাকুরী করছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে আছি। সরকারের কাছে আকুল আবেদন তিনি যেন আমাদেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির এমপিও ভুক্তির জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেন। 

ছিটমহলের বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, শেখ হাসিনা সরকার আমাদেরকে ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে সকল নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে। সরকার আমাদের অনেক উন্নয়ন করেছে। আজ আমার ছেলে আনারুল ইসলাম বিনা টাকায় বিনা সুপারিশে বিজিবিতে চাকরি করছে। এমন অনেকের পুলিশ, আর্মিতেও চাকরি হচ্ছে। বাংলাদেশ না হলে এটা সম্ভব হতো না। আমরা এখন গর্বের সহিত বসবাস করছি।

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় বাংলাদেশ অংশের দাসিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন জানান, যখন বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় হয়, তখন বাংলাদেশ থেকে ৬৫টি পরিবারের ১০৭ জন হিন্দু এবং ১০০ জন মুসলিম ভারতে যায়। আমাদের এই কালিরহাট বাজারে একটি মসজিদ আছে। তার ঠিক ১০০ গজ দূরে একটি বড় মন্দির আছে। যে যার ধর্ম পালন করছে। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমরা মুসলিম-হিন্দু মিলে অনেক ভালো আছি। বর্তমান সরকার আমাদের ভালো রেখেছে। তাই এই সরকারের র্দীঘায়ু কামনা করছি। 

বাংলাদশে-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমস্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সাবেক সভাপতি মইনুল হক জানান, র্দীঘ আন্দোলনের পর ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ছিটমহল বাসীর অন্ধকার জীবন থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ১ আগষ্ট থেকে ছিটমহলের মানুষ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পান। এই ৬ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের নেতৃত্বে দাসিয়ারছড়াসহ সকল ছিটমহলে শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও রাস্তা-ঘাটসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। 

উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুমন দাস বলেন, উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের মতো এখানেও সরকারের সকল দপ্তরের সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা রাস্তাঘাট বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে করা হয়েছে। এ ছাড়া পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নিতে সরকার সব ধরনের সহযেগিত করছে। উন্নয়ন করছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। ইতো মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১ হাজার ৬৪৩ একর ও সরকারি খাসখতিয়ানভুক্ত ৯ একর জমির প্রাক জরিপ শেষ করে খতিয়ান হস্তান্তর করা হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানায় খাজনা খারিজ জটিলতা থাকায় কেউ জমি বিক্রি এবং ক্রয় করতে পারছেন না। তাই জমি-সংক্রান্ত সমস্যাটি দ্রæত সমাধান হবে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য,বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছিটমহল নিয়ে স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ‘মুজিব-ইন্দিরা’ স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি দীর্ঘ সময় নানা কারণে বাস্তবায়ন না হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পায় এবং সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাসিয়ারছড়া বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়। 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন মাত্র | অর্ধ | যুগেই | উন্নত | জীবনের | সান্নিধ্যে | দাসিয়ারছড়াবাসী