আর্কাইভ থেকে আইন-বিচার

পিলখানায় নারকীয় হত্যাকাণ্ডের এক যুগ

পিলখানায় নারকীয় হত্যাকাণ্ডের এক যুগ

পিলখানা ট্র্যাজেডির  এক যুগ পূর্তি আজ। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য দিনগুলোর মতোই। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হওয়ার আগেই হঠাৎ ভারী অস্ত্র আর বুলেটের গর্জনে কেঁপে ওঠে পিলখানা। পিলখানার ভেতর থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দে রীতিমতো কাঁপন ধরে নগরবাসীর হৃদয়ে।

রাইফেলস সপ্তাহ ঘিরে সকাল থেকেই সেদিন গোটা পিলখানায় উৎসবের আমেজ চলছিল। কিন্তু ওই উৎসবের আড়ালে ষড়যন্ত্রের ছকে ঘাতকের দল শুরু করে ভয়াবহ নৃশংসতা। বিডিআর জওয়ানরা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ইতিহাসের কালো এই দিনে ভারি অস্ত্র আর বুলেটের গর্জনে প্রকম্পিত হয় গোটা পিলখানা।

২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় বার্ষিক দরবার বসে পিলখানার দরবার হলে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বর্ণাঢ্য ওই আয়োজনের দ্বিতীয় দিন। রাইফেল্স সপ্তাহ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এর আগেই শুরু হয় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড।

সারাদেশ থেকে আসা বিডিআরের জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ বিপুলসংখ্যক সদস্যে তখন দরবার হল পরিপূর্ণ। হলের মঞ্চে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওইদিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন।

দরবার শুরুর পর এক আনন্দঘন পরিবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। মহাপরিচালকের বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাম দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিত মঞ্চে প্রবেশ করে। ডিজির সামনে বন্দুকের নল তাক করে সিপাহি মঈন। আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে এ ঘাতক গুলি চালাতে না পারলেও অপর জওয়ানরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। 

দরবার হলের বাইরে থেকেও গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করে। তারা বৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে।

তারা অস্ত্রাগারটিও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহী জওয়ানরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনে। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখামাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে। নারকীয় হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে বিপথগামী বিদ্রোহীরা। মুহূর্তের মধ্যেই দেশের অন্যান্য বিডিআর ব্যাটালিয়নেও ছড়িয়ে পড়ে সেই বিদ্রোহ।

পিলখানার ভেতরে নৃশংসতা চলতে থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনা সদস্যরা ভারী অস্ত্র এবং সাঁজোয়া যান নিয়ে এসে সকাল ১১টার দিকে ধানমণ্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে পৌঁছে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা সদর গেট ও ৩ নম্বর গেট থেকে সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করেও গুলি ছোড়ে বিদ্রোহীরা। এ অবস্থায় বড় ধরনের রক্তপাতের আশঙ্কায় গোটা রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়।

২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। অস্ত্র সমর্পণের পর সিভিল পোশাকে পালিয়ে যান অধিকাংশ বিদ্রোহী। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান হয় ৩৬ ঘণ্টার বিদ্রোহের। তবে এ ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। দীর্ঘ ১২ বছরেও ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি নিহতদের স্বজনরা।

এ ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের জন্য একটি এবং বিস্ফোরক আইনে একটিসহ দুটি মামলা দায়ের হয়। হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ১৫২ জন বিডিআর জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬২ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২৫৬ জনকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ওই মামলা থেকে ২৭৮ জন খালাস পান।

এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। যাবজ্জীবন দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় আরো ২০০ জনকে। খালাস পান ৪৫ জন।

পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি। এ মামলায় আসামি ৮৩৪ জন।

নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের পর ঢেলে সাজানো হয় বিজিবিকে। ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে বিডিআর- এর নাম পরিবর্তন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজিবি করা হয়। বদলানো হয় বাহিনীর পোশাক, ব্যাজ এবং পতাকা।

এছাড়া ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিল ২০১০ পাস হয়। নতুন বর্ডার গার্ড আইনে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নাম পরিবর্তনসহ বিদ্রোহের কঠোরতর শাস্তির বিধান রাখাসহ বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়।

আজ (বৃহস্পতিবার) সেই ঘটনার বার্ষিকী পালন করবে বিজিবি। দিনের কর্মসূচিতে রয়েছে পিলখানাসহ বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন, বিজিবির সব মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় সকাল ৯টায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৩ বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একসঙ্গে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

এছাড়া দিবসটি পালন উপলক্ষে বিজিবির সকল স্থাপনায় বিজিবি পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবির সকল সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করবেন। শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বাদ জুমা পিলখানার বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেক্টর মসজিদ এবং বর্ডার গার্ড হাসপাতাল মসজিদে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

শুভ মাহফুজ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন পিলখানায় | নারকীয় | হত্যাকাণ্ডের | এক | যুগ