আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।বুধবার(১৬ নভেম্বর)প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর।যাচাই-বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, আবেদন নিষ্পত্তি ৬-১৫ ডিসেম্বর।মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। নির্বাচনী প্রচারণা চলবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি ২০২৪ সকাল ৮টা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণে তারিখ ৭ জানুয়ারি রোববার।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান এবং আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর কমিশনের হাতে বড় কয়েকটি ক্ষমতা থাকে।জনগণের মনেপ্রশ্ন দেখা দেয়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে কমিশনের হাতে কী ধরনের ক্ষমতা থাকে? সেই ক্ষমতা তারা কতটুকু প্রয়োগ করতে পারে?
বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তফশিল ঘোষণার পর আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনের মধ্যে রদবদল আনতে পারে।তারা বলছেন এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চিত করা আছে।নির্বাচন সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে।
ইসি চাইলে কর্মকর্তা বদলি
নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বলেন, তফসিল ঘোষণার পর আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনের মধ্যে রদবদল আনতে পারে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক,পুলিশ সুপার এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না।
অন্যদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি করার প্রয়োজন হলে করলে নির্বাচন কমিশন লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সে বদলি কার্যকর করতে হবে।
অন্যদিকে, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন,কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী যদি সরকার কাজ না করে তাহলে আইনের বরখেলাপ হবে। তিনি আরও বলেন,‘সাধারণত দেখা যায়, সরকার সবসময় তাদের পছন্দমতো কর্মকর্তাদের সেসব জায়গায় নিয়োগ করে দেয়। এটা সব সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’
বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম এবিষয়ে বলেন,তফসিল ঘোষণার পর আজ থেকে বদলি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে আগে থেকে ইসির অনুমতি নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ এবং আরপিও -এর ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচনের কাজে সহায়তা দেওয়া নির্বাহী বিভাগের কর্তব্য। কোনও কর্মকর্তা দায়িত্ব পাওয়ার পরে তাকে অব্যাহতি না দেয়া পর্যন্ত চাকরির অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি ইসির অধীনে প্রেষণে আছেন বলে গণ্য হবে।’
ইসি সচিব আরও বলেন, ‘এছাড়া আরপিও -এর ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচনের সময়সূচি জারি হওয়ার পর থেকে ফল ঘোষণার পর ১৫ দিন পর্যন্ত ইসির অনুমতি ছাড়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যত্র বদলি না করার বিধান রয়েছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা উপেক্ষা করা কিংবা তাদের সাথে আলোচনা না করার নজিরও রয়েছে।২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদকে সে জেলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়াই তাকে আবারো গাজীপুরে পুনর্বহাল করা হয়েছিল।যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, তিনি নির্বাচনের পরেই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল নির্বাচনের দুইদিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার জন্য।
কিন্তু সেটি করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা হতাশা প্রকাশ করেছিলেন।
তবে কোন নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কোন কর্মকর্তাকে বদলি করা কিংবা না করা হলে সেক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে?
‘এটা নিয়ে সরাসরি আইনে কিছু বলা নেই।সংবিধানে বলা আছে নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। কিন্তু যদি না করে বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই।’
নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বলেন, সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।
এক্ষেত্রে তিনি ভারতের উদাহরণ তুলে ধরেন। যদি সরকার নির্বাচন কমিশনের কোন অনুরোধ উপেক্ষা করে তাহলে সেখানে নির্বাচন কমিশন আদালতে চলে যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে কখনোই কোন ইলেকশন কমিশন আদালতে যায়নি।’
এবিষয়ে একটি উদাহরণ তুলে ধরে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনের ব্যত্যয় হলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে।
ইসি প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে
যদি কোন প্রার্থী নির্বাচনী আইন ও আচরণ বিধির গুরুতর লঙ্ঘন করেন, সেক্ষেত্রে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন।নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বলেন, ‘এ বিষয়টিতে নির্বাচন কমিশনের পুরোপরি এখতিয়ার আছে।’
তবে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোন উদারহণ নেই বলে উল্লেখ করেন পর্যবেক্ষরা।নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা ও সতর্ক করার নজির থাকলেও প্রর্থিতা বাতিলের বিষয়টি দেখা যায় না।
রিটার্নিং অফিসারকে নিয়ন্ত্রণ করা
বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে উল্লেখ করা আছে, একজন রিটার্নিং অফিসারকে নির্বাচন কমিশন যেভাবে দায়িত্ব দেবে,তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য থাকবেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীমের ভাষায় একজন রিটার্নিং অফিসার একটি এলাকায় ‘অল ইন অল’ বা সর্বেসর্বা। তার তত্ত্বাবধানের নির্বাচন পরিচালিত হয়।
জেলা প্রশাসকরা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা নন।তারা যদি নির্বাচনের কমিশনের নির্দেশনা মেনে না চলেন সেক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিবিসি বাংলাকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন,‘রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ ও বাতিল করা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তাকে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি বাতিল করতে পারে।’
ফলাফল বাতিল করতে পারে ইসি
গত ১৯শে মে গণপ্রতিনিত্ব আদেশের সংশোধনী অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়-নির্বাচনের পরে ফলাফল বাতিল করতে পারবে না কমিশন। এতে নির্বাচন কমিশনের ‘ক্ষমতা খর্ব হয়েছে’বলে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়।
তখন নির্বাচন কমিশনের সচিব গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে নির্বাচনী কার্যক্রম ও ভোট চলাকালে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনের হাতে আছে। যে সংশোধনী যুক্ত করা হয়েছে সেটি হচ্ছে ‘নির্বাচনের ফলাফল গেজেট বা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হবার পরে পুরো নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা যাবে না।’
পরবর্তীতে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে যে ভোট চলাকালীন নির্বাচনের কমিশনের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা আছে। কমিশন আবশ্যিক মনে করলে ফলাফল গেজেট প্রকাশ করা স্থগিত রাখতে পারবে।নির্বাচন কমিশন বলছে এই ক্ষমতা আগে ছিল না।
নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে, যেটি আগে পারতো না বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করছে। তদন্তের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সংগত মনে করলে যেসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করতে পারবে।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে গাইবান্ধায় একটি আসনে উপ-নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে সেদিনই ভোটগ্রহণ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের এই ক্ষমতা বহাল আছে।