আন্তর্জাতিক

‘নতুন ভীতি উসকে দিলো বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন’

‘নতুন ভীতি উসকে দিলো বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন’
বাংলাদেশের সদ্য অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একতরফা ভোট দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার শঙ্কাকেই বাস্তবে রূপ দিতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ভয়েস অব আমেরিকা তাদের এক প্রতিবেদনে এ শঙ্কার কথা জানিয়েছে। ‘ওয়ান-সাইডেড বাংলাদেশ ইলেকশন রেইজেজ অব ওয়ান পার্টি রুল’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কয়েকটি দল এই নির্বাচনকে ‘অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করলেও বেশ কিছু দেশের কর্মকর্তারা ভোটগ্রহণ ও এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। গেলো রোববার (৭ জানুয়ারি) বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে বিজয়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু প্রধান অন্যতম বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই বিরোধীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে বাধা দেয়া হয়। কখনো কখনো সেই দমন-পীড়ন সহিংসতায় রূপ নেয়। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এমন দমনপীড়নে হাজারো নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ভোট পর্যবেক্ষণে নির্বাচন কমিশন একদল আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন সাবেক মার্কিন কংগ্রেসম্যান জিম বেটস। তিনি রাজধানী ঢাকায় ভোট চলাকালীন বেশ কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। ভোটগ্রহণ শেষে এর মূল্যায়ন করতে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জিম বেটস বলেন, আমি বলবো এটা এরই মধ্যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু ভয়েস অব আমেরিকাকে এক ইমেইল বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক টিম পাঠায়নি মার্কিন ফেডারেল সরকার। সেখানে যাদের কথা বলা হচ্ছে সেটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। তার বা তাদের মন্তব্য ফেডারেল সরকারের নয়। এদিকে, নির্বাচন ঘিরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘ। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি এ বিষয়ে অন্য পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে একমত পোষণ করে যুক্তরাষ্ট্র। সব দলের অংশগ্রহণে এই নির্বাচন না হওয়ায় আমরা নিন্দা জানাই। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের সময়ে এবং আগের মাসগুলোতে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে তাতেও নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অতি জরুরি হলো মানবাধিকার, আইনের শাসন ও যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে নির্বাচন আয়োজন করা যেসব মানদণ্ড মানা হয়নি। বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ভোলকার তুর্ক বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েক মাসে বিরোধী দলের হাজারো নেতাকর্মীকে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে, না হয় ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। একটি সত্যিকার খাঁটি প্রক্রিয়ার জন্য এই কৌশল সহায়ক নয়। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে সবার অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানান। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দাবিদার পশ্চিমা দেশগুলোসহ এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ব্যাপকভাবে নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা করলেও তাদের একতরফা দাপটকে চ্যালেঞ্জকারী চীন ও রাশিয়া এবং তাদের একাধিক ঘনিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের অনেকে দ্রুততার সঙ্গে নবনির্বাচিত শেখ হাসিনার সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছেন শেখ হাসিনাকে। নিরঙ্কুশ এই বিজয়ের প্রশংসা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহতভাবে ঘনিষ্ঠ থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। ভিওএর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় অন্তবর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে বিরোধী জোট। কিন্তু সেই দাবি শেখ হাসিনা নাকচ করার পর সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। জনগণকে আহ্বান জানানো হয় সরকারকে কোনো সহযোগিতা না করতে এবং নির্বাচনে ভোট না দিতে। নির্বাচন কমিশন সরকারিভাবে যে হিসাব দিয়েছে তাতে ভোটার উপস্থিতি ছিল শতকরা ৪১ দশমিক ৮ ভাগ। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়া, পর্যবেক্ষক, মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো এমনকি যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তাদের এক অংশ এই সংখ্যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই সন্দেহের অন্যতম কারণ হলো ভোটার হার বাড়িয়ে দেখানো। নির্বাচন কমিশনের সচিব ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগের হিসাবে বলেছিলেন শতকরা ২৭ দশমিক ১৫ ভাগ ভোট পড়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত হিসাবে বলেছে ভোট পড়েছে শতকরা ৪১ দশমিক ৮ ভাগ। বিরোধীরা বলছেন, ভোটের শেষ এক ঘণ্টায় কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের দাবি মারাত্মক সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এর আগে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮০ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারিভাবে ২৯৮টি আসনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও কথিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যারা মূলত ক্ষমতাসীন দলটিরই নেতা- তারা ২৮০টি আসন নিশ্চিত করেছেন। ফল হিসেবে জাতীয় সংসদের শতকরা ৯৪ ভাগ আসনই ক্ষমতাসীন দলের দখলে। ২৭টি দল নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও এদের মধ্যে ২৩টি দল একটি আসনেও জিততে পারেনি। এক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, নির্বাচন হয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তার দল ১১টি আসনে জয় পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকার যাকে চায়, তিনিই জিতেছেন। আমি মনে করি এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ গ্লোবেল নিউজকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের লেজুরভিত্তিক একটি পাপেট বিরোধী দল বানাতে চাইছে যারা মূলত ক্ষমতাসীন দলকেই সমর্থন জানাবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন পরবর্তী দুটি অনুষ্ঠানে বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কর্মীদের মধ্যে জল্পনা দেখা দিয়েছে যে, বিএনপির রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নিতে পারে নতুন সরকার।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন নতুন | ভীতি | উসকে | দিলো | বাংলাদেশে | একতরফা | নির্বাচন