আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

পড়াশোনার ঝামেলা নেই যে দেশে

পড়াশোনার ঝামেলা নেই যে দেশে

সম্প্রতি জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো)-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায় পৃথিবীতে অন্যতম সেরা দেশ হলো ফিনল্যান্ড।

প্রতিবেদনটির তথ্য মতে, শিক্ষায় আমেরিকা, ব্রিটেনকেও অনেক ক্ষেত্রে হার মানায় ফিনল্যান্ড। অথচ, সেখানকার ছকভাঙা ব্যবস্থায় ছোট থেকে বাচ্চারা স্কুলেই যায় না। ছোটবেলায় হয় না কোনও পরীক্ষাও। স্কুলে গিয়ে বাচ্চারা খেলাধুলো করেই সময় কাটায়। 

তাহলে কোন মন্ত্রে পড়াশোনায় সেরার শিরোপা জিতে নিল এই দেশ? উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে এসেছে চমকপ্রদ কিছু তথ্য।

ফিনল্যান্ডের শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় সাত বছর বয়স থেকে। তার আগে তারা স্কুলেই যায় না। ছোটদের নার্সারি স্কুলের অস্তিত্ব অবশ্য ফিনল্যান্ডেও আছে, তবে সে সব স্কুলে লেখাপড়া নয়, বাচ্চারা খেলাধুলো করে।

ফিনল্যান্ডের মানুষ মনে করেন, সাত বছরের আগে শিশুদের মাথায় লেখাপড়া নিয়ে চাপ দেয়া উচিত নয়। তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের সময় দেয়া হয়। সাত বছর বয়সের আগে পরিবারের সদস্যদের কাছে শিশু লেখাপড়ার প্রাথমিক পাঠ পেতেই পারে, তবে স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ দেয়া হয় না।

ফিনল্যান্ডে সাত বছরের কমবয়সি শিশুদের শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতিটি একটু ভিন্ন রকমের। খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার সৃজনশীল সত্তার বিকাশ ঘটানো হয়। সমবয়সিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সকলে মিলেমিশে থাকা, এক সঙ্গে কোনও গঠনমূলক কাজ কর- এ সবই শিখানো হয় ছোটদের নার্সারি স্কুলে।

ফিনল্যান্ডের ফ্রাঞ্জেনিয়া ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রধান টিনা মারজোনিয়েমি বলেছেন, বাচ্চাদের খেলাধুলোর জন্য সময় দেয়া দরকার। ছোট থেকেই তাদের সৃষ্টিশীলতাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া দরকার।

ফিনল্যান্ডে শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল কেবল ন’বছর বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ সাত বছর বয়সে স্কুলে ঢুকে ১৬ বছরেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে দেয়া যায়। ইচ্ছা করলে অবশ্য ১৬ বছর বয়সের পরও শিক্ষার্থীরা স্কুলে বা কলেজে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারেন। তবে সবটাই ঐচ্ছিক।

এ দেশে কোথাও কোনও স্কুলে প্রথম ছ’বছর পরীক্ষা হয় না। শিশুদের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবকে প্রশ্রয় দেন না ফিনল্যান্ডের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ১৬ বছর বয়সে সকলকে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় বসতে হয়। তার নাম ‘ন্যাশনাল ম্যাট্রিকুলেশন এক্সাম’।

সংবাদ মাধ্যমের তথ্য বলছে, পৃথিবীর সমস্ত স্কুলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে কম সময় ক্লাস করে ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা। তবু তাদের শিক্ষাগত পারদর্শিতা অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি বলে দাবি করা হয়েছে রিপোর্টে। এখানকার স্কুলে মাত্র পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টা ক্লাস হয়। স্কুল শুরু হয় সকাল ৮টা- ৯টা নাগাদ। স্কুলে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে খাবার দেয়া হয়। দুপুরে স্কুলেই তারা পেট পুরে খাওয়াদাওয়া করে। এরপর দুপুর ২টার মধ্যেই বেজে ওঠে ছুটির ঘণ্টা।

স্কুলে প্রতি ৪৫ মিনিট পড়াশোনার পর ১৫ মিনিটের বিরতি দেয়া হয়। শুধুমাত্র খেলাধুলোর জন্য দেয়া হয় এ বিরতি।

ফিনল্যান্ডে কোনও স্কুলের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। সব স্কুলই সমান। যে কোনও স্কুলে যে কোনও ছাত্রছাত্রীকেই সমান গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়। ফিনিশীয়রা মনে করেন, প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতাই সাফল্যের চাবিকাঠি। এ দেশে বেসরকারি স্কুলের কোনও অস্তিত্বই নেই।

ইউনেসকোর রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, পৃথিবীর যোগ্যতম এবং দক্ষতম শিক্ষকদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছেন ফিনিশীয় শিক্ষকরা। শিক্ষকের চাকরি পেতে এ দেশে যত মানুষ আবেদন জানান, তাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ সুযোগ পান চাকরিতে। ডাক্তার বা আইনজীবীর তুলনায় এখানে শিক্ষকদের গুরুত্ব কিছু কম নয়।

স্কুলে টানা ছ’বছর ধরে পড়ুয়ারা একই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকে। ফলে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় হয়। আর একেই ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ মনে করা হয়।

স্কুলে বাচ্চারা প্রথমেই ফিনিশ ভাষা শিখে। তারপর শিখানো হয় সুইডিশ। তারপর তৃতীয় ভাষা হিসাবে বাচ্চারা ১১ বছর বয়স থেকে ইংরেজি শিখতে শুরু করে। স্কুল শেষের পরীক্ষায় ইংরেজি থাকেই না। পরীক্ষা হয় প্রথম দুই ভাষার উপর।

এই শিক্ষাব্যবস্থাতে পড়াশোনায় সাফল্যের মুখ দেখেছে ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা। ফিনল্যান্ডের স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেখানকার ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতি বছর হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হয়। সে দেশে নিরক্ষর কেউ নেই বললেই চলে।

অনন্যা চৈতী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন পড়াশোনার | ঝামেলা | নেই | দেশে