টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার পর দ্বিপক্ষীয় ভারত সফর শেষে এবার চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর এই ‘হাই ভোল্টেজ’ সফরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ তথ্য জানিয়েছেন। তবে ঢাকা-বেইজিংয়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে চীনা ঋণ, বিনিয়োগ ও বাংলাদেশের তিস্তা ইস্যুই প্রাধান্য পাচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ার একাধিক সূত্র বায়ান্ন টিভিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ৬ষ্ঠ ও ৯ম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পিপল টু পিপল কানেকটিভিটি বিষয়ক।
ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ার একাধিক সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বেইজিংয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ছেন, প্রায় একই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও মস্কোর পথে দিল্লি ছাড়ছেন। এবারের চীন সফর বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার ভারত ও চীন সফর হচ্ছে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের।
বেইজিং সফরকালে বুধবার (১০ জুলাই) চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাত হবে। পরে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও চীনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠকে তিস্তা নিয়ে চীনের প্রস্তাব আছে কিনা বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে দুই দেশের ওই ‘হাইভোল্টেজ’ বৈঠকে তিস্তা প্রকল্প ও রোহিঙ্গা সঙ্কট ইস্যুতে চীনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসার সম্ভাবনা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ার একাধিক সূত্র বিষয়টি বায়ান্ন টিভিকে নিশ্চিত করেছে।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, ‘হাইভোল্ডেটজ বৈঠকে তিস্তা প্রকল্প, রোহিঙ্গা সমস্যা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য চীনের ঋণ নেওয়ার বিষয়টি আলোচিত হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তিস্তা প্রকল্পে ভারত নাকি চীন কাকে যুক্ত করা হচ্ছে-এই প্রশ্নটি বেশ কয়েক মাস ধরে আলোচনায় রয়েছে। সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সফরে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে দিল্লির প্রস্তাব সম্পর্কে ঢাকার কাছে জানতে চাইতে পারে বেইজিং। পাশাপাশি বেইজিং নিজের প্রস্তাবও ঢাকার সামনে তুলে ধরতে পারে।
এক্ষেত্রে চীন ও ভারত উভয় দেশই যাতে চিন্তিত না হয় বাংলাদেশের সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এগোনো উচিত বলে মনে করেন পেশাদার এই কূটনীতিক। তার মতে তিস্তা প্রকল্পে ভারত ও চীনকে যৌথভাবে যুক্ত করা গেলে সেটাই হয়তো সবচেয়ে ভালো হতে পারে বাংলাদেশের জন্য।
তবে এবিষয়ে পুরোপুরি একমত হতে পারছেন না আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। বায়ান্ন টিভিকে তিনি বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বেইজিং কোনো প্রস্তাব দিলে সেটাই ঢাকার গ্রহণ করা উচিত। ভারত যেহেতু বছরের পর বছর বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে দিচ্ছে না, তাই দিল্লির দিকে তাকিয়ে না থেকে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে মহাপরিকল্পনার যে উদ্যোগ ঢাকা নিয়েছে সেখানে আগ্রহী বেইজিং। একারণে চীনের সেই আগ্রহকে কাজে লাগাতে ঢাকার অবশ্যই কাজ করা উচিত।
তবে তিস্তা প্রকল্পে ভারত ও চীনকে যৌথভাবে যুক্ত করা গেলে বাংলাদেশের জন্য ভাল বলে মুন্সী ফয়েজ আহমেদ যে মন্তব্য করেছেন তার সঙ্গে একমত অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের কোনো একপাক্ষিক অবস্থান নেয়া সঠিক হবে না। বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে নীতিতে বিশ্বাসী সেই নীতি মেনে তিস্তা সঙ্কটের সমাধান করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বলেছেন-ভারত ও চীনের মধ্যে যার প্রস্তাব ভাল বিবেচনায় আসবে বাংলাদেশ তার প্রস্তাব গ্রহণ করবে। এবিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘ প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। দেশের স্বার্থ আগে দেখতে হবে। লাভ-লোকসান বিবেচনায় আনতে হবে। তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে ভারতের মতো চীনকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি মহা প্রজেক্ট চীনের টাকায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। এবার হয়তো বেইজিংয়ের কাছে প্রচুর ঋণও চাইবে ঢাকা। চীনও ঋণ দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। তবে ঋণ পাওয়ার জন্য তিস্তা প্রকল্পের প্রস্তাব দেশের জন্য মঙ্গলজনক না হলে তা গ্রহণ করা ঠিক হবে না। তিস্তা প্রজেক্টে ভারত-চীনের যৌথ প্রস্তাব আসলে সবচাইতে ভালো হতো। তবে দিল্লি-বেইজিংয়ের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে শীতলতা বিরাজ করায় সেই সুযোগ নাও আসতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক পাড়ার অনেকে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে নতুন সরকার গঠন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন সরকারের বিরাট প্রত্যাশা, ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা একটা স্মার্ট দেশ হবো। এগুলোর জন্য যে ধরনের বিনিয়োগ দরকার। চীন এই বিনিয়োগের একটা বড় উৎস হতে পারে।’
এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বায়ান্ন টিভিকে বলেছেন, চীন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কৌশলগত উন্নয়ন অংশীদার। এটি কিন্তু কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশে পররাষ্ট্রনীতি, উন্নয়ন এবং বাজারই এদেশের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে চীনের আগ্রহ বাড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা চারবার ক্ষমতায় থাকাকালে একাধিকবার চীন সফর করেছেন। তাঁর কারণেই চীন আজ বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগি দেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ব্যাপক অর্থ প্রয়োজন। দরকার চীনা বিনিয়োগ। অন্যদিকে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এসব নিয়ে আলোচনার জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সাবেক এই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ বাংলাদেশ-চীনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পররাষ্ট্র নীতি বিশেষ করে রাজনৈতিক দিক থেকে চীনকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে বাংলাদের অবস্থান কী সেটি তুলে ধরা হতে পারে। এছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে যেহেতু চীনের সম্পর্ক ভালো তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীনের সহযোগিতা বিষয়টি দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উঠতে পারে।