গেলো শুক্রবার হোয়াইট হাউসে বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাস্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির এমন বাগবিতণ্ডা বিরলই বটে। যুক্তরাষ্ট্রের আড়াইশো বছরের ইতিহাসেতো বটেই, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সামনাসামনি তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম।
বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চটে গিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউজ থেকে চলে যেতে বলেন। শুধু তাই নয়, হোয়াইট হাউজে দুপুরের খাবারও খেতে পারেননি জেলেনস্কি। হো্য়াইট হাউজের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো যৌথ সংবাদ সম্মেলনও বাতিল হয়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির এমন আচরণে রাগান্বিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, জেলেনস্কির অপমানে ‘ফুসছে’ প্রায় গোটা ইউরোপ। ওই বৈঠকের জেরে ৩৬০ ডিগ্রি বাক নিচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি। দ্রুত বদলাতে শুরু করছে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সমীকরণ। লন্ডন সম্মেলনে যেনো তারই আভাস পাওয়া গেলো।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার আয়োজিত ‘সিকিউর আওয়ার ফিউচার’ শীর্ষক এই সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরারাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট-ন্যাটো, ইউরোপের ২৭ দেশ নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনে ইউক্রেনের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেয় যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। ইউরোপের অন্যান্য দেশও তাদের দেখানো পথে হাঁটে। ফ্রান্স, ইতালিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ মিলে নতুন একটি জোট গঠনসহ চারটি বিষয়ে একমত হয়েছেন বলে জানান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমরা ইউক্রেনে আমরা সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখবো এবং ইউক্রেনকে শক্তিশালী করতে রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে থাকব। দ্বিতীয়ত, আমরা সবাই একমত হয়েছি, যেকোনো যেকোনও শান্তি চুক্তিতে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং যে কোনও আলোচনার টেবিলে ইউক্রেনের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। তৃতীয়টি হলো- একটি শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের যেকোনো আগ্রাসন ঠেকাতে আমরা অবশ্যই ইউক্রেনের নিজস্ব প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা বাড়াতে থাকবো। চতুর্থত ইউক্রেনের নিরাপত্তায় ও দেশটির শান্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি জোট গঠনের প্রক্রিয়ার দিকে আমরা অগ্রসর হবো।’
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার চার বছরের মধ্যেই পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক জোট ন্যাটো গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। শুরু থেকেই ইউরোপের দেশগুলো প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রবলভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়ে এই নীতিতে পরিবর্তন আনেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য প্রতি বছর কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করতে রাজি নন তিনি। এর জন্য প্রয়োজনে ন্যাটো ত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। শুধু তাই নয়, ইউক্রেনকে সহায়তার পরিবর্তে দেশটির খনিজ সম্পদেও ভাগ বসাতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প যে ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে মোটেই ভাবেন না, জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর ইউরোপের নেতাদের কাছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির মতো শক্তিশালী দেশগুলো। ইউক্রেন ইস্যুতে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ গড়তে চেষ্টা চালাচ্ছে দেশগুলো।
ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠক ভেস্তে পাওয়ার পর ইউক্রেনের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে ব্রিটেন। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কিয়েভকে ২৮০ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাজ্য। ফলে আগামী দিনে লড়াই আরও ছড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কোন খাতে বয়ে চলে, সেটাই এখন দেখার বিষয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এমআর//