আপনি কি কখনো লক্ষ্য করেছেন আপনার আশেপাশে এমন কেউ রয়েছেন, যিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে সহজেই কেঁদে ফেলেন? হয়তো কোনও সাধারণ কথা, ছোট্ট কোনও মন্তব্য বা সম্পর্কের ছোটখাটো সমস্যার কারণে অযথা তাদের অশ্রু ফেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে কি জানেন মনোবিজ্ঞানে এমন প্রতিক্রিয়ার পিছনে রয়েছে এক গভীর প্রক্রিয়া।
মনোবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কেঁদে ফেলা শুধুমাত্র একটি আবেগের প্রকাশ নয় বরং, এটি মানসিক চাপ, অতিরিক্ত উদ্বেগ কিংবা অনিয়ন্ত্রিত আবেগের ফল হতে পারে। যখন কোনও ব্যক্তি সহজেই কেঁদে ফেলেন এর পেছনে বেশ কিছু মনস্তাত্ত্বিক এবং জীববিজ্ঞানের কারণ কাজ করে।
বিশ্ববিদ্যালয় অব ক্যালিফোর্নিয়ার মনোবিজ্ঞানী ড. ইলিনা বার্নস এ বিষয়ে এক গবেষণায় বলেছেন, কেউ যখন কিছু বললেই কেঁদে ফেলেন এটি আসলে সেই ব্যক্তির মনের অবস্থা এবং তার জীবনে আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর প্রতিফলন।
ড. ইলিনা বার্নস আরও জানান, অশ্রু শুধু যন্ত্রণার প্রতীক নয়। এটি এক ধরনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া যা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে আবেগী চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে হয়। এই সময় অশ্রু নিঃসরণের মাধ্যমে শরীর নিজেকে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে।
তাছাড়া এর পাশাপাশি একজন ইমোশনাল থেরাপিস্ট ড. রেহান খান বলেছেন, এ ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে যে, সেই ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ মানসিক চাপ অত্যধিক। কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা হওয়া আসলে অনেক সময় মানসিক চাপের নিঃশব্দ সংকেত। আসলে যা নির্দেশ দেয়, তাকে আরও বেশি সহানুভূতি ও মনোযোগ প্রয়োজন। কিছু সাধারণ কারণ যা মানুষের অতিরিক্ত আবেগের ফলস্বরূপ হতে পারে।
অতীতের মানসিক আঘাত:
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অতীতে মানসিক আঘাত পেয়েছেন। যেমন শৈশবকালে সহিংসতা বা অবহেলা। তারা সাধারণত সহজেই আবেগপ্রবণ হয়ে যান।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ড. নাদিয়া সালেহ বলেন, যখন কোনও ব্যক্তি অতীতের ক্ষত থেকে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করতে পারেন না, তখন তাদের মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আত্মবিশ্বাসের অভাব:
আত্মবিশ্বাসের অভাব বা খারাপ আত্মমূল্যবোধও এক বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। একজন ব্যক্তির নিজের উপর আত্মবিশ্বাস কম থাকলে, সেসব মন্তব্য বা পরিস্থিতি তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে তার আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হতে পারে।
জীবনযাত্রার চাপ:
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ড. লুসি ড্রামন্ড এক গবেষণায় বলেছেন, চাপপূর্ণ পরিস্থিতি যেমন পারিবারিক সমস্যা বা কাজের চাপ, মানুষের আবেগকে অস্থির করে তোলে। এসব পরিস্থিতিতে সহজেই কেঁদে ফেলা একটি সুরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া।
হরমোনাল পরিবর্তন:
শরীরের হরমোনাল পরিবর্তনও অনেকসময় অতিরিক্ত আবেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে, মাসিক চক্র, গর্ভাবস্থা বা মেনোপজের সময় হরমোনের তারতম্য ব্যক্তির আবেগের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
পূর্বের এক গবেষণায় একজন প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. মেরি হাওয়েল বলেছেন, এমন পরিস্থিতি যেখানে মানুষ সহজেই কেঁদে ফেলেন তা আসলে তাদের নিজেদের আবেগের নিয়ন্ত্রণের অভাবকে চিহ্নিত করে। এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো সাধারণত আবেগপ্রবণতার প্রকাশ, যা তাদের মানসিক সুস্থতার ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়া পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ড. রিচার্ড গর্ডন বলেছেন,মানসিকভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে, মানুষের মস্তিষ্ক প্রাথমিকভাবে তাদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য আত্মরক্ষা হিসেবে কাঁদার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটি কোনও ধরনের মানসিক দুর্বলতা নয় বরং, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এ ধরনের আচরণ যদি স্থায়ী হয়ে যায় এবং জীবনে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তবে এটি মানসিক সমস্যার দিকেও ইঙ্গিত করতে পারে।
এ বিষয়ে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. সিমা হোসেন বলেন, এমন অনুভূতির সাথে মোকাবিলা করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্য থেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নেয়া উচিত। এটি দীর্ঘমেয়াদী ব্যক্তির মানসিক শান্তি এবং সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
অর্থাৎ, যখন কেউ কিছু বললেই কেঁদে ফেলে তার পেছনে মানসিক চাপ, অতীতের অভিজ্ঞতা, শারীরিক অবস্থা এবং আবেগের প্রতি অযত্ন এগুলোই প্রধান কারণ। যদিও এটি একটি সাধারণ আচরণ তবে একে উপেক্ষা না করে যথাযথ মানসিক সহায়তা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যাতে ভবিষ্যতে কোনও ধরনের মানসিক অস্বস্তি বা সমস্যার সৃষ্টি না হয়।
এসকে//