ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সার বিশ্বের অন্যতম মারাত্মক এবং ভিন্নধর্মী এক ধরনের ক্যান্সার। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আজকাল এটি একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই রোগের প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা অব্যাহত রয়েছে এবং সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সম্ভব।
ব্রেস্ট ক্যান্সার হচ্ছে এমন একটি রোগ যেখানে স্তনের কোষগুলি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধি পায় এবং টিউমার তৈরি করে। এটি শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সাধারণত একটি গুটি বা টিউমারের আকারে স্তনে অনুভূত হয়। তবে এর পাশাপাশি আরও অনেক লক্ষণ থাকতে পারে।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ :
ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঠিক কারণ এখনো সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর কিছু কারণ থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
জেনেটিক কারণ:
যুক্তরাজ্যের লন্ডন ইউনিভার্সিটির ড. হেলেন হ্যানকক বলেন, ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি জেনেটিক মিউটেশন। যেমন BRCA1 এবং BRCA2-র কারণে বৃদ্ধি পায়। যার পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস রয়েছে, তাদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে।
হরমোনাল পরিবর্তন:
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ড. ক্রিস কোলম্যান জানান, ব্রেস্ট ক্যান্সারের বৃদ্ধিতে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
লাইফস্টাইল ও বয়স:
কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির ড. মিশেল ক্লার্ক বলেন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও মদ্যপান এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
ম্যাক্সিমাম স্তন্যদান না করা:
গবেষণায় বলা হয়েছে, যারা দীর্ঘকাল স্তন্যদান করেন না, তাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ :
ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ সাধারণত প্রথমে স্তনে একটি গুটি বা টিউমার আকারে দেখা দেয়। তবে অন্যান্য লক্ষণও সেক্ষেত্রে থাকতে পারে। যেমন: স্তনে ব্যথা বা অস্বস্তি,স্তনের ত্বকের পরিবর্তন (রঙের পরিবর্তন বা সেঁটে যাওয়া),স্তন থেকে তরল নিঃসরণ (যেমন দুধ বা রক্ত),স্তনের আকার বা গঠন পরিবর্তন, কাঁধ বা হাতে ব্যথা
যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিস ইউনিভার্সিটির ড. লিন্ডা গডফ্রে বলেন, ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ প্রথম দিকে সহজেই শনাক্ত করা যায় না। তবে নিয়মিত চেকআপ করলে এটি দ্রুত সনাক্ত করা সম্ভব।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রতিরোধ ও স্ক্রীনিং :
ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং সঠিক সময়ে সনাক্তকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে এই রোগের প্রতিরোধ ও স্ক্রীনিংয়ের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ড. রিচার্ড অ্যালান জানান, নিয়মিত স্ক্রীনিং এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণের সুযোগ বৃদ্ধি করে।
ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে-এর গবেষকরা জানান, প্রতিবার ৩-৪ বছরে একটি মেমোগ্রাম পরীক্ষা করা উচিত। বিশেষ করে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের জন্য।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা :
ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর অবস্থার উপর। সাধারণত চিকিৎসার তিনটি প্রধান পদ্ধতি রয়েছে:
সার্জারি:
যদি ক্যান্সার স্তনে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে অস্ত্রোপচার করে টিউমার বা আক্রান্ত স্তন অপসারণ করা হয়।
কেমোথেরাপি:
কেমিক্যাল ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।
রেডিয়েশন থেরাপি:
রেডিয়েশন প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়।
হরমোনাল থেরাপি:
হরমোনের প্রভাব কমিয়ে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি থামানো হয়।
বিশ্বব্যাপী ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে নানান গবেষণা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট (NCI) এবং ইউএস সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজি (ASCO)-এর গবেষকরা নিয়মিত নতুন ওষুধ এবং চিকিৎসার পদ্ধতি উদ্ভাবন করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ড. এলিজাবেথ গ্রিন বলেন, এখনকার দিনে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি এবং জীবনের প্রতি সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যান্সারকে অনেকটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে সচেতনতা ও সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এটি অনেকাংশে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা সম্ভব।
কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির ড. মিশেল ক্লার্ক জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রথম দিকে সনাক্তকরণের সুযোগ থাকলে এর চিকিৎসা সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নিয়মিত স্ক্রীনিং এবং সচেতনতার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে মহিলারা এই রোগের প্রতি সচেতন হন এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন।
এসকে//