ফিলিস্তিনের গাজাবাসীর, ক্ষুধার আর্তনাদ বোমার শব্দের মতোই কর্কশ ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। সেখানে সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি, সুপরিকল্পিতভাবে ক্ষুধা ও অভাব সৃষ্টি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো হুঁশিয়ারি দিয়েছে, এই 'নীরব যুদ্ধ'ই গাজার সাধারণ মানুষের জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি।
একদিকে গাজায় টানা বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ করছে ইসরাইলী বাহিনী। অন্যদিকে একটি ঘৃণ্য কৌশল হিসেবে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। গাজাবাসীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার প্রচারণা চালাচ্ছে।
গেল জুন মাসে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল। এই সংস্থার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কর্মকর্তা ক্যাথরিন রেভি বলেছেন,“ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ক্ষুধাকে ব্যবহার করছে। যুদ্ধের শুরুতেই গাজার ওপর সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। সেখানে খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং স্যানিটারি সামগ্রী যেতে দিচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন,“ইসরায়েল গাজাবাসীর জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত শিল্প, ভবন ও অবকাঠামো যেমন বেকারি, মাছের খামার এবং গুরুত্বপূর্ণ পানিশোধনাগারগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষকে বেঁচে থাকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে। যাতে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়।
সীমান্তে শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক থেমে আছে। অথচ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষগুলো খাবারের জন্য ত্রাণকেন্দ্রে ছুটে চলেছে।
নাসের হাসপাতালের শিশু চিকিৎসা বিভাগের প্রধান ডা. আহমেদ আল-ফাররা বলেন, পরিকল্পিতভাবে একটি যুদ্ধনীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। একটি প্রজন্মকে লক্ষ্য করে আঘাত করা হচ্ছে। শিশুদের জন্য ও নবজাতকদের মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, বিদ্যুৎ নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের প্রথম তিন বছরে সঠিক পুষ্টি না পেলে, তাদের বুদ্ধি, বোঝার এবং যোগাযোগের সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মে মাসে, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন গাজায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নেয়। আগে অন্যান্য সংস্থা এই দায়িত্ব পালন করত। তবে এই নতুন ব্যবস্থার কড়া সমালোচনা করেছেন অনেকেই। এই সংস্থার কঠোর নিয়মনীতি নিয়ে সমলোচনা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এই সংস্থা ইসরায়েলের বাস্তুচ্যুতির কৌশলে সহায়তা করছে।
ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কর্মকর্তা ক্যাথরিন রেভি বলেছেন, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন মূলত একটি মার্কিন ভাড়াটে সংস্থা। যারা ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ত্রাণ বিতরণ করছে। বাস্তবে এই সংস্থাটি ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ত্রাণ নিতে গেলে তাদের ফাঁদে ফেলে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। এটি ত্রাণ বিতরণ নয়। মানবিক সহায়তার ছদ্মবেশে নিপীড়ন চালানো।
ডা. আল-ফাররা বলেন, সেখানকার মানুষের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হচ্ছে। অনেক মানুষকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তারা স্নাইপারের গুলিতে শরীরের ওপরের অংশে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গেল দুই-তিন সপ্তাহে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ জন নিহত হয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চেয়ে তিনি বলেন, যতদিন না ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশের পক্ষপাতদুষ্ট সমর্থন পাচ্ছে, ততদিন তারা এই অপকর্ম করবে।
অন্যদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ইসরায়েল যুদ্ধের অংশ হিসেবে সাধারণ জনগণকে না খাইয়ে মারার মতো যুদ্ধাপরাধে যুক্ত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এটিকে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের একটি হামলায় দক্ষিণ ইসরায়েলে ১১শ’৩৯ জন নিহত হন। ২০০ জনের বেশি ইসরাইলী নাগরিককে অপহরণ করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর জবাবে ইসরায়েল ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়। সর্বশেষ হিসাবে এসব অভিযানে ৫৮ হাজার ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১লাখ ৩৮ হাজার ৫শ’ ২০ জন।