আর্কাইভ থেকে শিল্প-সাহিত্য

শুভ জন্মদিন গল্পের জাদুকর...

শুভ জন্মদিন গল্পের জাদুকর...
“পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অলৌকিক সঙ্গীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়..” নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন আজ। বেঁচে থাকলে আজ ৭৪ বছরে পা দিতেন তুমুল পাঠকপ্রিয় এই লেখক। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নেই। কিন্তু কে বলবে তা? তিনি নেই, তবুও যেন আরও বেশি রয়ে গেছেন তার না থাকা জুড়ে। তার লেখাতে আজও মাতোয়ারা পাঠক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় এই কিংবদন্তির জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে। আজকের এ দিনটিকে  স্মরণীয় রাখতে  হুমায়ূন ভক্ত তরুণ-তরুণীরা পালন করছে ‘হিমু দিবস’। গল্প, উপন্যাস, কবিতা ছাড়াও হুমায়ূনের পদচারণে ছিল নাটক-গান ও সিনেমায়। শিল্প-সাহিত্যের সব অঙ্গনেই তরুণদের কাছে তিনি অনুকরণীয়।
জন্মদিন
জন্মদিন
হুমায়ূন আহমেদের বহুমাত্রিক রচনা সহজেই পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্প সহজ-সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় উঠে এসেছে তার লেখনীতে। ব্যক্তি মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আবেগ-অভিমান, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা আর সমাজের প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবনের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ অসাধারণ নৈপুণ্যে প্রতিভাত তার সৃষ্টিতে। হুমায়ূনের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য চরিত্র নির্মাণ। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো যেন বার বার ফিরে আসে পাঠক মনে। হিমু, মিসির আলী, শুভ্ররা যেন পাঠকের অনেক কাছের মানুষ। এগুলো প্রতীকী চরিত্র হলেও এদের সবারই মিল যেন প্রগাঢ় মানবিক মূল্যবোধে। সেটা হোক চিন্তা-ভাবনায় উদ্ভট হিমু বা যুক্তিবাদী সত্যসন্ধানী মিসির আলী কিংবা বিবেকবান শুভ্র। হুমায়ূনের গল্প, উপন্যাসের বিভিন্ন ছোট ছোট উক্তি পাঠকের কাছে খুবই জনপ্রিয়। যেমন- বাদশাহ নামদারে লিখেছেন, ‘রাজা যায়, রাজা আসে। প্রজাও যায়, নতুন প্রজা আসে। কিছুই টিকে থাকে না। ক্ষুধার্ত সময় সব কিছু গিলে ফেলে, তবে গল্প গিলতে পারে না। গল্প থেকে যায়।’ ‘এই পৃথিবীতে চোখের জলের মতো পবিত্র তো আর কিছু নেই। এই পবিত্র জলের স্পর্শে সব গ্লানি-সব মালিন্য কেটে যায়।’- কুহক   রজনীতে লিখেছেন, ‘মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে মাঝে মাঝে তার সব কিছু পেছনে ফেলে চলে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে যেতে পারে না। তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কিসের অপেক্ষা তাও সে ভালোমতো জানে না।’ প্রেম-বিরহ-রাজনীতি নিয়ে এমন আরও অসংখ্য উক্তি আছে, যা পাঠকমুখে বেশ জনপ্রিয়। আশির দশকে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক ধারাবাহিকের ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে হুমায়ূনের প্রথম টেলিভিশন নাটক ‘প্রথম প্রহর’। আর প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ ব্যাপকভাবে দর্শক-সমাদৃত হয়। এছাড়াও রয়েছে ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আজ রবিবার’, ‘নক্ষত্রের রাত’সহ তুমুল জনপ্রিয় বহু একক ও ধারাবাহিক নাটক। চলচ্চিত্র নির্মাণেও সার্থক ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’ ও ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র। নির্মাণ করেছেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘আমার আছে জল’ এবং ‘ঘেটু পুত্র কমলা’র মতো সব চলচ্চিত্র। চার দশকের সাহিত্য জীবনে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে পান ‘একুশে পদক’। এছাড়াও তাঁর অর্জিত পুরস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে- লেখকশিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার, হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার। দেশের বাইরেও সম্মানিত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। জাপানের এনএইচকে টেলিভিশন তাকে নিয়ে 'হু ইজ হু ইন এশিয়া' শিরোনামে ১৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রচার করে। আর চলচ্চিত্রে ১৯৯২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কাহিনীকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার ও শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে তিনি মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার পেয়েছেন।
জন্মদিন
জন্মদিন
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে এগিয়ে নিতে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অপরিসীম। এককভাবে বইয়ের বাজার সৃষ্টি করে ও প্রকাশনা শিল্পে প্রবাহ তৈরির মধ্য দিয়ে এ শিল্পে গতিশীলতা নিয়ে এসেছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন অমর একুশে গ্রন্থমেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। চলে যাওয়ার পরও বইমেলায় তাঁর বই কিনতে পাঠক ভিড় করেন। বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় এই কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্রকার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০১২ সালের ২৩ জুলাই নিউইয়র্ক থেকে দেশে আনা হয় নন্দিত এই লেখকের মরদেহ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে পরদিন তাকে সমাহিত করা হয় তার নন্দনকানন নুহাশপল্লীর লিচুতলায়। হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস দুই শতাধিক। উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে- নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমণি, লীলাবতী, কবি, সাজঘর, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাব যাব, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি। তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'দেয়াল'ও পায় আকাশচুম্বী পাঠকপ্রিয়তা। তিনি রচনা ও পরিচালনা করেছেন বহু একক ও ধারাবাহিক নাটক, চলচ্চিত্র।  

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন শুভ | জন্মদিন | গল্পের | জাদুকর