ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে শরীরে বাধে নানা রোগ। কখনো জ্বর-সর্দি কখনো বা পেটে ব্যথা। আর এই একটু অসুস্থতায় ভুগলেই আমরা ডাক্তারের কাছে দৌঁড়াই। কিন্তু খুব বিষণ্ণ বা দুশ্চিন্তায় কাটানো দিনগুলোতে কখনো কি কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেই আমরা? উত্তরটা “না”।
কেন চিকিৎসকের পরামর্শ নেই না? স্থূলভাবে এর দুটো কারণ হতে পারে। মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রেও যে চিকিৎসা আবশ্যক- সেই বিষয়ে অজ্ঞতা এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা।
মানসিক স্বাস্থ্যকে সুস্বাস্থ্যে তৈরি করতে আজকের আলোচনা।
তবে এর আগে জানতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য কি?
শারীরিক স্বাস্থ্য বলতে যেমন আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থতাকে বোঝায়, ঠিক তেমনি আমাদের আবেগ-অনুভূতির সঠিক বহিঃপ্রকাশ এবং আচরণের স্বাভাবিকতাকে মানসিক স্বাস্থ্য বলে। মানসিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিক থাকলে পারিপার্শ্বিক বিষয় যেমন ভয়, দুশ্চিন্তা, রাগ, উদ্বেগ আমাদের চিন্তা-চেতনা বা সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
মানসিক সুস্থতা কাকে বলে জানেন?
আপনি কতটা স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, তা নির্ভর করে আপনার মানসিক সুস্বাস্থ্যের উপর। ব্যক্তির চিন্তা ও অনুভূতির সামঞ্জস্যই মানসিক সুস্থতা।
মানসিক সুস্থতা কি তা জানলেন, তাহলে মানসিক অসুস্থতা কি?
যখন আমাদের স্বাভাবিক আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি, কাজ করার মানসিক শক্তিতে বিঘ্ন ঘটে, সেই অবস্থাকে বলা হয় মানসিক অসুস্থতা। মানসিক অসুস্থতার ফলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ থেকে শুরু করে আত্মঘাতী হয়ে ওঠার মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতিও অনেক সময় তৈরি হয়।
মানসিক সুস্থতার লক্ষণ কি হতে পারে?
মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে আপনি খুব সহজেই আপনার মনের নেতিবাচকতা, রাগ, ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। জীবনের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন। মানসিক সুস্থতার লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আত্মবিশ্বাস, বেঁচে থাকা ও কাজের মধ্যে একটা তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া, সুন্দর ও স্বাভাবিক সম্পর্ক, প্রাত্যহিক জীবনের নানা প্রতিকূলতার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া ইত্যাদি।
এর জন্য কিছু করণীয় তো আছে আমাদের মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য আমরা কিছু কিছু কাজ খুব সহজেই করতে পারি। যেমন-
শারীরিক কসরত
শারীরিক কসরতের মানে এই নয় যে, দিনের অনেকটা সময় আপনাকে শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে বা জিমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে শরীরের ঘাম ঝরাতে হবে।
শারীরিক কসরত হলো, আপনি যে কাজ বা ব্যায়ামগুলো করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে থাকেন, সেগুলোই করুন। রোজ নির্দিষ্ট সময়ে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন; সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো বা নৃত্য পরিবেশনায় পারদর্শী হয়ে থাকলে প্রত্যহ তা অনুশীলন করতে পারেন। আপনি চাইলে কানে হেডফোন গুঁজে পছন্দের কোনো গান শুনতে শুনতে কয়েক রাউন্ড দৌড় দিতে পারেন।
যখন আপনার শরীর ঝরঝরে থাকবে, তখন মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটবে, যার ফলে মনে একধরনের প্রশান্তি বিরাজ করবে এবং মন উৎফুল্ল থাকবে। এর মাধ্যমে ব্যক্তির দৃঢ় সংকল্পতা বৃদ্ধি পাবে এবং লক্ষ্য অর্জনে মন বদ্ধপরিকর হয়ে উঠবে।
মিশতে হবে অন্যদের সাথেও
কথায় আছে ‘নানা মুনির নানা মত’। প্রত্যেকটি মানুষের চিন্তা-ধারা, আচরণ, প্রতিক্রিয়া, কার্য সম্পাদনের পরিকল্পনা ও কৌশল সর্বোপরি জীবন-ধারণের ধারা আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
স্বপরিবার মিলে খাবারে টেবিলে একসাথে খেতে পারেন।
পরিবারের অনেককেই প্রয়োজনে দিনের বেলা বাইরে থাকতে হয়, তাই রাতে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে সকলে মিলে রাতের খাবার একসাথে খেলেন এবং সবার সাথে সবার কথাও হলো। অবসরে বাচ্চাদের বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সময় দিন।
বন্ধুরা এতে বাদ যাবে কেন?
আধুনিকতার যুগে মুঠোফোনের বার্তালাপে বা সামাজিক মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমেই শুধু আমাদের সম্পর্কগুলোকে জিইয়ে না রেখে বরং সামনাসামনি সাক্ষাতের মাধ্যমে সম্পর্কগুলোকে সতেজ করে তুলি। এতে সম্পর্ক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য উভয়ই বজায় থাকবে।
অনেকদিন বন্ধুর সাথে দেখা হয় না। কোনো এক ছুটির দিনে খানিকটা সময় বের করে বন্ধুর সাথে না হয় একদিন দেখা করতে গেলেন। পুরনো সুন্দর স্মৃতিগুলো আপনার মনকে সুন্দর অনুভূতির অনুরণনে সতেজ করে তুলবে।
কর্মব্যস্ততায় প্রতিটি দিনের সিংহভাগ সময় যাদের সাথে বা পাশে বসে কাজ করতে হয়, একদিন কাজের ফাঁকে বা ছুটির দিনে সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেতে খেতে না হয় কাজের বাইরের দুনিয়াটা নিয়েও একটু কথা বললেন। এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো আপনার অস্তিত্ব ও একজন মানুষ হিসেবে ভালোভাবে বেঁচে থাকার ইতিবাচক অনুভূতিকে জাগ্রত করবে।
জীবনে উদার হওয়ার প্রয়োজন
অন্যকে সাহায্য বা পাশে দাঁড়ানোর জন্য আপনার খুব ছোট একটি কাজ বা ক্ষেত্রবিশেষে বড় কোনো পদক্ষেপই যথেষ্ট।শরীরের জন্য যেমন ভিটামিন প্রয়োজন, এই সুন্দর অনুভূতিগুলোও আপনার মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য ভিটামিন।
মাসের বেতন পেয়ে যখন কেনাকাটা করতে যাবেন, হয়তো খেয়াল করবেন, নিজের জন্য না কিনে বরং পরিবারের সদস্যদের জন্য তাদের পছন্দের জিনিসগুলো কিনতেই আপনি বেশি আনন্দবোধ করছেন। উদারতা এবং অন্যের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যে আপনি যে আনন্দ পাবেন, আপনার মনে যে পবিত্র অনুভূতি জাগ্রত হবে তা এককথায় ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
কেউ আপনার একটা উপকার করলে তাকে হাসিমুখে একবার ধন্যবাদ বলুন। এতে তার যেমন ভালো লাগবে, দেখবেন আপনারও ভালো লাগছে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশেও ইতিবাচকতা রয়েছে।
আমাদের মাঝে এমন অনেক আপনজন বা বন্ধু-বান্ধব রয়েছে যাদের মানসিক বা আর্থিক সাহায্যের খুব প্রয়োজন। আপনার দেয়া একটু
সমর্থন তাদের মুখে যে হাসি ফোটাবে, তা নিঃসন্দেহে আপনার মনকে শান্ত করবে। দিতে পারার আনন্দ সীমাহীন।
নিজের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা
আমাদের প্রত্যাশা এবং প্রচেষ্টার মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক হয়ে যায়, তখন না পাওয়ার অনুভূতিতে মনে কষ্ট তৈরি হয়। এর থেকে পরিত্রাণের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, নিজেকে নিজে জানা। আপনি যদি আপনার সক্ষমতা, অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা সর্বোপরি শারীরিক শক্তিমত্তা সম্পর্কে অবগত থাকেন, তাহলে আপনি সেই অনুযায়ীই প্রত্যাশা করবেন।
আপনি কেবল সেটুকুই প্রত্যাশা করবেন, যা আপনি অর্জন করতে পারবেন। এতে আপনার মধ্যে ইতিবাচক চিন্তা এবং আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বেড়ে যাবে। আকাশ-কুসুম প্রত্যাশার অপূর্ণতা আপনার মনকে কখনোই উদ্বিগ্নতা বা বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দেবে না।
নতুন কিছু শেখার প্রয়াস
‘নতুন’ শব্দটির সাথেই যেন একধরনের আনন্দ জড়িয়ে থাকে। আপনার যে বিষয়ে ভালো লাগে বা যা কিছু শিখতে চান, শত ব্যস্ততার মাঝেও খানিকটা সময় বের করে যদি তা শেখার ব্যাপারে নিয়মিত অনুশীলন করতে থাকেন, তবে তাতে আনন্দ পাবেন। আর আনন্দ মানেই মন ভালো থাকা, মনের স্বাস্থ্য অটুট থাকা তথা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকা।