১৮৩০-এর দশকে তিন বাঙালি জুটি বেঁধে অবিভক্ত বাংলাকে দিয়েছিলেন অনন্য এক উপহার। বর্ধমানের রাজা মহারাজাধিরাজ বাহাদুর মহতাব চাঁদ রায় (ওরফে চুনি লাল কাপুর), বিপ্রদাশ মুখোপাধ্যায় নামক জনৈক বাঙালি, ও নৃত্যলাল সিল নামক একটি প্রিন্টিং প্রেসের নাম না জানা মালিক; এ তিনজন একত্রে একটি রান্নাবিষয়ক বই প্রকাশ করলেন।
১৮৩১ সালে প্রকাশিত পাকরাজেশ্বর নামক ওই বইটি ছিল রান্নার প্রণালি বিষয়ক ভারতবর্ষের ও বাংলা ভাষার প্রথম বই। এ বই সূচনা করেছিল বাংলা ভাষায় রেসিপি বইয়ের যাত্রা।
রাজা মহতাব চাঁদ ছিলেন শিল্প ও শিক্ষার সমঝদার। এ দুই খাতের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন তিনি। অন্যদিকে শিক্ষামনষ্ক বিপ্রদাশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন লেখক, সম্পাদক, ও খাদ্যরসিক। নৃত্যলাল সিলের মালিক সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি।
পাকরাজেশ্বর বইয়ের বিশেষত্ব কেবল এর রেসিপি ছিল না। বরং বইটিতে রান্নার উপকরণগুলো তালিকা আকারে লেখার পাশাপাশি সেগুলোর প্রতিটির স্বাস্থ্যগুণগুলোও সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা ছিল।
বিপ্রদাশ মুখোপাধ্যায় তার দ্বিতীয় বইটি প্রকাশ করেন দীর্ঘ ২৭ বছর পরে, ১৮৫৮ সালের দিকে। ব্যঞ্জন রত্নাকর নামক ওই বইটি বাংলা ভাষায় রান্নার বইয়ের আরেকটি প্রাথমিক সংযোজন। বলা বাহুল্য, সে সময় বাংলায় রান্নাপ্রণালির আধুনিক কোনো বই ছিল না।
বাঙালির রান্না ও খাদ্যাভাসের যেটুকু আলাপ তার আগে পাওয়া যেত, সেগুলো ছিল চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল-এর ভেতর। তখনকার জাতপাতের ভেদ মানা বাঙালি কী ধরনের খাবার খেত সে বিষয়ে মঙ্গলকাব্যগুলো থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
যেমন, আদিবাসী নিষাদ দম্পতি কালকেতু ও ফুল্লরাকে দেখা যায় শূকর ও শজারুর মতো অবিক্রীত শিকার খেতে। অন্যদিকে ধনাঢ্য বণিক ধনপতি ও তার দুই স্ত্রী লহনা ও খুল্লনা খান মাছ, সবজি, দুধ ইত্যাদি ভালো ভালো খাবার দিয়ে।
অন্নদামঙ্গলে খাবার হিসেবে কচ্ছপের ডিম ও শুঁটকির কথাও উল্লেখ আছে। তবে ১৯ শতকের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে এ খাবারগুলো খাওয়া ধর্মচ্যুত হওয়ার মতো পাপ ছিল।
এ মঙ্গলকাব্যগুলো থেকে বাঙালির খাদ্যরীতি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার অবকাশ নেই। বরং তার জন্য ফিরে দেখতে হবে গত দুই শতকে লেখা বিভিন্ন রেসিপি বইগুলোর দিকে।
মুখোপাধ্যায় তার বইয়ের জন্য একাধিক উৎসের ওপর ভরসা করেছিলেন। ক্ষেমশর্মার লেখা সুপ্রাচীন ভারতীয় রান্নাপ্রণালি বিষয়ক গ্রন্থ ক্ষেমকুতুহলম, পুরাণের উল্লেখ করা রান্না, মোগল আমলের রান্নার বিষয়ক বই নুসখা-ই শাহজাহানি ইত্যাদি গ্রন্থের তথ্যসূত্র রয়েছে তার বইয়ে।
রাজা বিক্রমাদিত্যের দরবারের সদস্য ছিলেন ক্ষেমশর্মা। আর নুসখা-ই শাহজাহানি লেখা হয়েছিল মোগল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামালে।
১৮৮৯ সালে বিপ্রদাশ মুখোপাধ্যায় সৌখিন-খাদ্য-পাক প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। এটাতে ছিল খেচরান্ন তথা খিচুড়ি (চাল, ডাল, মশলা, ঘি), পোলাও, কোর্মা, কাবাব, কোপ্তা, কাটলেট, চপ ইত্যাদি রান্নার প্রণালি। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডটি ছিল ইংরেজি খাবারের রেসিপি। এ দুই খণ্ড মিলিয়ে ১৯০৬ সালে পাক-প্রণালী গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ বইয়ে অবশ্য বাড়তি কিছু রেসিপিও ছিল।
এ পাক-প্রণালীই মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। আধুনিকায়নের (পড়ুন সমসাময়িকতা) ওপর গুরুত্ব রেখে তিনি পুরো বইতে রন্ধনপ্রণালিকে যেভাবে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন, তা ছিল প্রশংসাযোগ্য। রেসিপি নিয়ে জানানোর আগে মুখোপাধ্যায় বইয়ের সূচনাতে ভালো খাবার বিষয়ে তার নিজের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন যেখানে একইসঙ্গে যত্নের ছাপ এ পুষ্টির প্রতি গুরুত্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
পাক-প্রণালীর উপক্রমণিকায় বিপ্রদাশ বাঙালি মা ও বউদের হিন্দুধর্মের খাদ্যের দেবী অন্নপূর্ণা'র (শিবের স্ত্রী) সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ঘরে রান্না করা খাবারই তার বেশি পছন্দের।
বিপ্রদাশ লেখেন, 'রমণীগণই গৃহের লক্ষ্মী; অন্নপূর্ণার ন্যায় তাঁহারা স্বীয় হস্তে রন্ধন করিয়া স্বামী ও আত্মীয়-স্বজনকে আহার প্রদান করিলে যে কি সুখের ও পরিতোষের কারণ হয়, তাহা কথায় বলিয়া শেষ করা যায় না।'
প্রায় ১৬টি পরিচ্ছেদ রচিত বইটির শুরুতে বিপ্রদাশ আদর্শ রান্নাঘর ও ভাঁড়ার ঘর কেমন হওয়া উচিত তার বর্ণনা করেছেন। একইসঙ্গে এগুলোর তত্ত্বাবধানের বিভিন্ন উপায়ের কথাও লিখেছেন তিনি। রান্নাঘর, বাসনপত্র, রান্নার দ্রব্য ইত্যাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাটা জরুরি বলে জোর দিয়েছেন বিপ্রদাশ। আচার, ঘি, শস্যদানা ইত্যাদি মাঝেমধ্যে রোদে দেওয়ার পরামর্শও রয়েছে তার বইয়ে।
রান্নাঘর নিয়ে লেখার অনুপ্রেরণা বিপ্রদাশ পেয়েছেন ইংরেজদের জীবনযাত্রার রীতিনীতি থেকে। শ্যাডো অব সাবসটেন্স-এ মেরেডিথ ব্রথউইক লিখেছেন: 'দৈনন্দিন কাজকর্ম নারীরা অন্তঃপুর থেকেই সারতেন। পুরুষদের জন্য থাকত বৈঠকখানা, যেখান থেকে সহজেই বাইরের রাস্তা দেখা যেত।'
ব্রথউইক আরও লেখেন: 'যদিও বহির্বাড়িতে যথেষ্ট স্থান ও বায়ুচলাচলের সুযোগ ছিল, অন্তঃপুরগুলোতে মলিনতার ছাপ ছিল প্রবল। কার্যকর চিমনিবিহীন রান্নাঘরে ধোঁয়া বের হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল না। আর এগুলোর সঙ্গেই বাস ছিল অন্তঃপুরবাসিনীদের।'
তবে একটু বিত্তশালী পরিবারগুলোর অন্তঃপুরে খানিকটা খোলা জায়গার দেখা মিলত, আর ওটুকু দিয়েই অল্প পরিমাণে সূর্যের আলো ভেতরে প্রবেশ করত। এ খোলা অংশে নারীরা বসে গল্প করতেন, সময় কাটাতেন।
পাক-প্রণালী বইটির শেষে বিপ্রদাশ অনেকগুলো সবজি ও মশলার একটি তালিকা রেখেছেন। এগুলোর প্রতিটির পুষ্টি ও পথ্যগুণও বর্ণনা করতে ভোলেননি তিনি। আর পথ্যগুণ বর্ণনার জন্য তিনি আশ্রয় নিয়েছেন বৈদ্য শাস্ত্র তথা আয়ুর্বেদের।
(নীলশ্রী বিশ্বাসের বই 'ক্যালকাটা অন ইওর প্লেট'-এর স্ক্রল ডটইন-এ প্রকাশিত সারাংশ থেকে থেকে সংক্ষেপে অনূদিত)