বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের প্রচুর মিথ্যা মামলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
টেলিফোনে কথা হচ্ছিলো তিরিশের শেষের কোঠায় বয়স এমন একজন ব্যক্তির সাথে। কয়েক বছর আগের ঘটনা বলছিলেন তিনি।
প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। শ্বশুর বাড়ির লোকজন বেশ কিছুদিন পর সে বিয়ে মেনেও নিয়েছিলো।
কিন্তু কিছুদিন পর স্ত্রীর পরিবারের এক আত্মীয়র সাথে জমিজমা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পরেন।
আর সেটি হয়ে ওঠে পুরো পরিবারের সাথে বিবাদ। এমনকি স্ত্রীর সাথেও শুরু হয় সমস্যা।
তিনি বলছিলেন, "তারা আমার বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করেছিলো। সেই মামলায় আমি একমাস কাস্টডিতে ছিলাম। সেই মামলায় আমি অব্যাহতি পাই। এরপর তারা আবার মামলা করে নারী নির্যাতনের। সেটি তদন্তের পর আদালত আমাকে খালাস দেয়। আদালতে মামলা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।"
নারী নির্যাতনের মামলা কিছুদিন চলার পর আদালত থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাসও পেয়েছেন এই ব্যক্তি।
তার অনুরোধে আমরা তার নাম পরিচয় গোপন রাখছি। তবে নতুন জীবনে ফিরতে অনেক সময় লেগে গেছে তার।
আদালত পাড়ায় এমন বেশ কিছু ঘটনা জানা গেলো।
স্ত্রী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে পরে উল্টো উচ্চ আদালতে মামলা করে জয়ী হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
জামিন কঠিন হওয়ায় অনেকে আইন অপব্যবহার করেন।
ছবির উৎস,ALLISON JOYCE
ছবির ক্যাপশান,
জামিন কঠিন হওয়ায় অনেকে আইন অপব্যবহার করেন।
প্রচুর মামলা, মিথ্যে অভিযোগ
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের প্রচুর মিথ্যা মামলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে পুলিশ বলছে নারী নির্যাতনের মামলার আশি শতাংশরই কোন প্রমাণ মেলেনা।
পুলিশের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস বলছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় জামিন পাওয়া সহজ নয় বলে অনেকে এর অপব্যবহার করছেন।
তিনি বলছেন, "যারা ফ্যব্রিকেটেড মামলা দেন তাদের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটা বড় সুবিধা হল যে এই আইনে জামিন পেতে বেগ পেতে হয়। আগে আইনটি জামিন অযোগ্য ছিল।এখন কিছু ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া যায়। মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে আসামিকে জেলে থাকতে হয় না হয় অনেকে পালিয়ে থাকে। জামিন কঠিন হওয়ায় অনেকে এটি অপব্যবহার করেন। খুব দ্রুততম সময় এই মামলায় হয়রানি করার একটা সুযোগ রয়েছে।"
তিনি আরো বলছেন, "এর মামলা খুব দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করতে হয়। ৯০ দিনের মধ্যে। এ জন্য মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। মামলা করার পর প্রতিপক্ষ যে একটা চাপে থাকে, হেনস্তা হয় সে কারণে যাদের সাথে বিবাদ তারা হয়ত আপোষ করে ফেলে।"
সহেলী ফেরদৌস বলছেন, বাংলাদেশে জমিজমা সংক্রান্ত মামলাই সবচাইতে বেশি হয়ে থাকে।
জমিজমার মামলা সময় সাপেক্ষ হয়। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবেও অনেক সময় নারী নির্যাতনের মামলা জুড়ে দেয়া হচ্ছে, বলছিলেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে পুলিশের দেয়া হিসেবে ২০১৭ সালে দেশব্যাপী ১৫ হাজারের কিছু বেশি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে।
বহু মামলা বিচার পর্যন্ত গড়ায়না।
ছবির উৎস,NURPHOTO
ছবির ক্যাপশান,
বহু মামলা বিচার পর্যন্ত গড়ায়না।
যারমধ্যে প্রায় চার হাজার মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তে ঘটনার কোন প্রমাণ পায়নি বলে মামলা বিচার পর্যন্ত গড়ায়নি।
অথবা ঘটনা মিটমাট হয়ে গেছে বলে মামলা তুলে নেয়া হয়েছে।
পুলিশ বলছে প্রচুর মামলা রয়েছে যাতে পরিবারের একজন দোষী হলেও পুরো পরিবারকে জড়ানো হয়েছে।
'আইনজীবীরাই মন্ত্রণাদাতা'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান বলছেন এমন মামলা মূলত হচ্ছে নানা জনের বুদ্ধিতে।
তবে আইনজীবীরাই অনেকক্ষেত্রে মন্ত্রণাদাতা বলছিলেন তিনি।
তিনি বলছেন, "মন্ত্রণাদাতা প্রথমত হচ্ছে পরিবারের মানুষজন। পরিবারের আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে উকিল। মানুষ যখন মামলা করে শুরুতেই কিন্তু একজন উকিলের কাছেই যায়। অনেক সময় উকিলের কথায়ও এমন মামলা হয়।"
বাংলাদেশে পুলিশের হিসেবে ২০১৭ সালে প্রায় সাড়ে আট হাজার নারী নির্যাতনের মামলার রায় হয়েছে।
মাত্র সাড়ে পাঁচশ সাতাশটি মামলায় অভিযুক্তর সাজা হয়েছে। আর বাদবাকি সবগুলোতে অভিযুক্ত খালাস পেয়েছেন।
কিন্তু তার অর্থ কি এত বিপুল পরিমাণে নারী নির্যাতনের মামলার সবগুলোই মিথ্যা মামলা?
আইনমন্ত্রী বলছেন যৌতুকের মিথ্যা মামলা করলে সাজার প্রস্তাব নিয়ে আইন আসছে।
ছবির উৎস,BBC BANGLA
ছবির ক্যাপশান,
আইনমন্ত্রী বলছেন যৌতুকের মিথ্যা মামলা করলে সাজার প্রস্তাব নিয়ে আইন আসছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালকদের একজন নীনা গোস্বামী বলছেন বিচার চলাকালীন সময় নানা সংস্থার কার্যক্রম, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা ও অন্যান্য দুর্বলতার কারণে মামলার অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি বলছেন তার অর্থ এই নয় যে মামলাগুলোই মিথ্যে।
তিনি বলছেন, "আমাদের অভিজ্ঞতা একে বারেই আলাদা। নারীরা সহজে মামলাটা করতেই চায়না। সেই মামলা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে যদি প্রমাণিত না হয় তার মানে এর অর্থ এই না যে এটি মিথ্যা মামলা।"
তিনি বলছেন, "অনেক সময় সাক্ষী অভাব থাকতে পারে, তদন্তে ত্রুটি থাকতে পারে, হয়ত ঠিকমতো আলামত সংগ্রহ হল না এসব ত্রুটি বিচ্যুতির দায়তো নারীর না। নির্যাতিত নারীর জন্য ধীরে ধীরে কিন্তু বিচার পাওয়ার যায়গাটুকু সংকুচিত হয়ে যায়। মামলা ফাইল হওয়ার পর বিচার পাওয়া পর্যন্ত যেতে একটা দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের দেশে আছেই। এসব পারিপার্শ্বিক কারণে আমরা দেখি যে মামলা প্রায়ই প্রমাণিত হয়না"
কিন্তু তাহলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর হিসেব এমন কেন?
অন্যদিকে বিচারকদের সভায়ও নানা সময় নারী নির্যাতন সম্পর্কিত অসংখ্য মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে এগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
আর সম্প্রতি বাংলাদেশে যৌতুক নিয়ে মিথ্যা মামলা নিয়ে জাতীয় সংসদে নতুন একটি আইনের খসড়া উত্থাপন করা হয়েছে।
মিথ্যে মামলা সম্পর্কে মানবাধিকার কর্মীরা দ্বিমত পোষণ করছেন
ছবির উৎস,MUNIR UZ ZAMAN
ছবির ক্যাপশান,
মিথ্যে মামলা সম্পর্কে মানবাধিকার কর্মীরা দ্বিমত পোষণ করছেন
যা কিছুদিন আগে মন্ত্রীসভায় অনুমোদন পেয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে এমন মিথ্যে মামলা করল পাঁচ বছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
সরকার এমন আইনের কেন প্রয়োজন বলে মনে করছে?
জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে।
তিনি বলছেন, "এই আইনগুলি করার পরে একটা জিনিস যা দেখা যাচ্ছে যে এই আইনগুলির কিছু অপব্যবহার করা হয়। যেমন ধরুন স্বামীর সাথে বিরোধ। তখন শ্বশুর শাশুড়ি দেওর ননদ তাদেরকে জড়িয়ে মামলা করা হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে তারা কিছুই জানে না। এসব বিবেচনায় রেখে আমরা মনে করছি যে এমন কিছু দরকার তাই বিশেষ আইনি যৌতুকের মিথ্যা মামলার বিষয়টি সংযুক্ত করতে চাচ্ছি।"
তার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম এমন মামলার কোন সঠিক হিসেব রয়েছে কিনা।
তিনি বলছেন, "আমি এটুকু বলতে পারি এটার সংখ্যা যে মারাত্মক তা না কিন্তু এটার একটা সংখ্যা আছে। আমরা চাচ্ছি সব পক্ষই যেন ন্যায্য বিচার পায়"
অন্যদিকে মানবাধিকার কর্মী নীনা গোস্বামী বলছেন, "এমন আইন হলে আগে যাও কিছু নারী মামলা করে সাহসিকতার পরিচয় দিতেন এখন তারা আর তাও করতে চাইবেন না। কারণ বিচার চাইতে হলে নারীকেই কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে।"
মিথ্যে মামলার ধারনা সম্পর্কে মানবাধিকার কর্মীরা যে দ্বিমত পোষণ করছেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা, তদন্ত কর্মকর্তা বারবার বদলী হয়ে গেলেও তার সঙ্গে যোগাযোগের সহজ ব্যবস্থা করা, আর আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত করার জন্য নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে তবুও নারী নির্যাতনের মামলার অপব্যবহারের অভিযোগ যেমন রয়ে যাচ্ছে।
তেমনি এমন নির্যাতনের বিচার নারীরা পাচ্ছেন না তার অভিযোগও সমান পরিমাণে রয়েছে।