ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার মাঝ বরাবর একটি রাস্তা নির্মাণ করেছে ইসরায়েল। গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি চ্যানেল ফোরটিনের ইউটিউবে আপলোড একটি ভিডিওতে এটি দেখা গেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, গাজায় নতুন একটি রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী রাস্তাটি গাজার পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে গেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এতথ্য জানা গেছে।
স্যাটেলাইট চিত্রে এই রাস্তাটি দেখে তা যাচাই-বাছাই করে বিবিসি জানায়, ইসরায়েল বলছে, পণ্য ও ত্রাণ সরবরাহের উদ্দেশ্যে এই রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এটা হয়তো একটা স্থায়ী অবকাঠামো হতে পারে।
তাদের আশঙ্কা এটাকে হয়তো একটি প্রাচীর হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। যাতে করে ফিলিস্তিনিরা গাজার উত্তরাঞ্চলে তাদের বাসস্থানে ফিরে যেতে না পারে।
নতুন রাস্তাটি নাহাল অজ কিবুৎজ এর কাছে ইসরায়েল-গাজার সীমান্ত প্রাচীর থেকে শুরু হয়েছে। এটি গাজার উপর দিয়ে গিয়ে পশ্চিমে উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
রাস্তা তৈরি উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ্যাকব নেগেল বিবিসি অ্যারাবিককে বলেন, ‘নতুন কোন হুমকি তৈরি হলে যাতে নিরাপত্তা বাহিনী দ্রুত প্রবেশ করতে পারে তার জন্যই এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।’ তবে অনেক বিশ্লেষক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে, চলমান যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এই রাস্তাটি গাজায় রাখার ইসরায়েলি পরিকল্পনার অংশ হতে পারে।
নতুন রাস্তাটি গাজার উত্তরাঞ্চলের উপর দিয়ে চলে গেছে। গাজার মধ্য এবং দক্ষিণাংশ এর নিচের দিকে রয়েছে। এবিষয়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বোলছে, তারা ‘সামরিক বাহিনী পরিচালনার জন্য একটি সামরিক এলাকা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে যাতে সেনাদের চলাচল ও যন্ত্রপাতি পরিবহন সহজ করা যায়।
ইসরায়েলি সীমান্তের কাছে গাজার পূর্বাঞ্চলে এই রাস্তাটির প্রথম অংশ নির্মাণ শুরু হয় গত অক্টোবরের শেষ এবং নভেম্বরের শুরুর মাঝামাঝি সময়ে। নতুন নির্মিত রাস্তাটি গাজা নিয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধ পরবর্তী কৌশল নিয়ে আবারো বিতর্ক উস্কে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিবিসি বোলছে, এর আগে থাকা সংযোগহীন সড়কগুলো সংযুক্ত করতে আইডিএফ পাঁচ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা নতুন করে তৈরি করেছে। কিন্তু নতুন রাস্তাটির বেশিরভাগ অংশই তৈরি করা হয়েছে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চের প্রথমদিকে। শুধু সালাহ আল-দীন সড়ক ছাড়া গাজার বাকি সব রাস্তার তুলনায় নতুন রাস্তাটি বেশ চওড়া।
ছবি বিশ্লেষণ করে বিবিসি জানায়, রাস্তাটির পাশে যেসব ভবন ছিল যেগুলো গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হত, সেগুলো ডিসেম্বর মাসের শেষ থেকে শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।এরমধ্যে বহুতল একটি ভবনও রয়েছে।
রাস্তাটি এমন একটি এলাকায় তৈরি করা হয়েছে যেদিকে এর আগে গাজার অন্যান্য অংশের তুলনায় কম ভবন এবং কম জনবসতি ছিল।
ইসরায়েলের কেন এই রাস্তা নির্মাণ?
জেনস নামে একটি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা কোম্পানির বিশ্লেষকরা বলেন, চ্যানেল ফোরটিনের ভিডিওতে যে কাঁচা রাস্তা দেখা যাচ্ছে সেগুলো সাঁজোয়া যান চলাচলের জন্য উপযুক্ত।
আইডিএফ এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, স্থল অভিযানের অংশ হিসেবে, আইডিএফ অভিযানের স্বার্থে যাতায়াতের জন্য একটি রাস্তা ব্যবহার করছে। এবিষয়ে ইসরায়েলের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক প্রধান জেনারেল জ্যাকব নেগেল বলেন, এর মাধ্যমে ইসরায়েলের জন্য ভেতরে প্রবেশ এবং বের হতে সুবিধা হবে... কারণ গাজার পূর্ণ প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা এবং সব ধরণের দায়িত্ব থাকবে ইসরায়েলের হাতে। রাস্তাটিকে তিনি “গাজার উত্তরাঞ্চলকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্নকারী রাস্তা” হিসেবেও মন্তব্য করেন।
সাবেক ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা জাস্টিন ক্রাম্প যিনি সিবিলাইন নামে একটি রিস্ক ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি পরিচালনা করেন, তিনি এই রাস্তাটিকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, ‘অবশ্যই দেখে মনে হচ্ছে যে গাজা উপত্যকায় অন্তত কিছু নিরাপত্তা হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এটা দীর্ঘ মেয়াদি কোন কৌশলের অংশ।’
যুক্তরাজ্যের সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই এলাকা গাজা শহরটিকে উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চল থেকে পৃথক করে ফেলছে, যা একে একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করছে যার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। একই সাথে গুলি ছোড়ার জন্য তুলনামূলক খোলা এলাকাও তৈরি করেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো খালিদ এলগিন্ডিও মনে করেন এই রাস্তাটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অংশ। তিনি জানান, ‘মনে হচ্ছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী অনির্দিষ্ট সময় ধরে গাজায় অবস্থান করবে।’
খালিদ এলগিন্ডিও আরও বলেন, ‘গাজাকে অর্ধেকে ভাগ করার মানে হচ্ছে ইসরায়েল শুধু গাজায় প্রবেশ ও বের হওয়ার উপরই নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছে না, বরং গাজার অভ্যন্তরীণ চলাচলের উপরও তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এর অংশ হতে পারে গাজার দক্ষিণে আশ্রয় নেয়া ১৫ লাখ ফিলিস্তিনিকে উত্তরাঞ্চলে তাদের বাড়ি-ঘরে ফিরতে না দেয়া।’