আন্তর্জাতিক

৬ মাসে হামাসকে কতটুকু ধ্বংস করতে পেরেছে ইসরায়েল

৬ মাসে হামাসকে কতটুকু ধ্বংস করতে পেরেছে ইসরায়েল
গত বছরের ৭ই অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের যোদ্ধারা গাজা থেকে ইসরায়েলে প্রবেশ করার পর ছয় মাস হয়ে গেছে। ওইদিন হামাস হামলা চালিয়ে ইসরায়েলে প্রায় ১২০০ মানুষকে হত্যা করে এবং শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। এর জবাবে ‘হামাসকে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ধ্বংস করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাজায় সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয় বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রশাসন।  সামরিক অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিলো হামাস যাতে তাদের জন্য আর কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে এবং ইসরায়েল যেন তাদের সব জিম্মিকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারে। ইসরায়েলের চালানো সেই অভিযান এখনও চলছে।  গত বছরের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর ছয় মাস পার হয়ে সাত মাসে গড়িয়েছে। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজা এরইমধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। হাজারো ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলে হামলায় অন্তত ৩৩ হাজার ১৩৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং গাজার বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া হামলায় ধসে পড়া ভবন ও ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। তারা সবাই মারা গেছেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন আরও লাখ লাখ মানুষ। ইসরায়েলি বাহিনী পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে রাখায় গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এত কিছুর পরও ইসরায়েলের তরফ থেকে যুদ্ধ বন্ধের কোনো লক্ষণ নেই। বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইসরায়েল বলেছে তাদের সামরিক অভিযানে হাজার হাজার হামাস যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। শুধু তাই নয়,গাজার তলদেশে সুড়ঙ্গের বিশাল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার দাবি করেছে তেলআবিব। ৭ই অক্টোবরের আগে, গাজায় হামাসের প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল।  আইডিএফ কমান্ডারদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে এটি বলা হয়েছে। ইসমাইল হানিয়াহ এর মতো হামাসের অনেক ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব  বিদেশে থাকেন। তবে এর অনেক সামরিক নেতৃত্ব কাঠামো গাজার অভ্যন্তরে রয়েছে বলে মনে করা হয়। আইডিএফ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা প্রায় ১৩ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তবে সংখ্যাটি তারা কীভাবে গণনা করেছে তা জানায়নি। ইসরায়েল হামাস নেতাদের নাম প্রকাশ করে বলেছে যে তাদের হত্যা করা হয়েছে। অক্টোবর থেকে এইভাবে মোট ১১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগই যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত হামাসের শীর্ষ কোনো কমান্ডার নিহতের বিষয়টি ইসরায়েল জানাতে পারেনি। গত ২৬ মার্চ প্রথমবারের মতো দাবি করেছে তাদের হামলায় হামাসের সামরিক শাখার ডেপুটি কমান্ডার মারওয়ান ইসা নিহত হয়েছেন। তবে হামাসের সবচেয়ে সিনিয়র নেতা ইসার নিহতের বিষয়টি হামাস কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেনি বা এবিষয়ে কোনো বিবৃতিও দেয়নি। গাজায় কতজন জিম্মি আছে? ইসরায়েলের সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ৭ই অক্টোবর ২৫৩ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে:১০৯ জনকে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসাবে বা পৃথক চুক্তিতে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সামরিক অভিযানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সরাসরি উদ্ধার করেছে মাত্র তিন জনকে। ১২ জন জিম্মির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে তিন জন আইডিএফ তাদের একটি অভিযানে নিহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে। এখনও যেসব ইসরায়েলি জিম্মি জীবিত আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাদের মধ্যে কনিষ্ঠ জিম্মির বয়স ১৮ এবং সবচেয়ে বয়স্ক জন ৮৫ বছর বয়সী।অন্য  ১২৯ জন জিম্মির মধ্যে অন্তত ৩৪ জন মারা গিয়েছেন বলে ইসরায়েল জানিয়েছে। হামাস জানিয়েছে, আইডিএফ এর বিমান হামলার কারণে মৃত জিম্মির সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না। হামাস হামলা চালিয়ে যাদের জিম্মি করেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ দুই জিম্মি হলেন এরিয়েল এবং কেফির। হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক কতটা ধ্বংস হয়েছে? হামাস শুরু থেকেই বলে আসছিলো তার টানেল নেটওয়ার্ক ৫০০ কিলোমিটার (৩১১ মাইল) প্রসারিত। তবে তাদের দাবি কোনোভাবেই যাচাই করতে পারেনি বিবিসি। ইসরায়েল  ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) এর মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস অক্টোবরে বলেছিলেন, ‘গাজা উপত্যকাকে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য একটি স্তর এবং তারপরে হামাসের জন্য আরেকটি স্তর হিসাবে ভাবুন। হামাস যে দ্বিতীয় স্তরটি তৈরি করেছে আমরা সেই দ্বিতীয় স্তরে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’ আইডিএফ  বিবিসিকে জানিয়ছিলো, তাদের বাহিনী "গাজায় সন্ত্রাসী অবকাঠামোর একটি বড় অংশ ধ্বংস করেছে"। আইডিএফ মাঝে মাঝে হামাসের সুড়ঙ্গে ঢুকে প্রমাণ দেখিয়েছে যে তারা এমন অনেক সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করেছে। উদাহরণস্বরূপ, নভেম্বরে, আইডিএফ গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের নীচে একটি টানেল নেটওয়ার্কের অংশের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে। তারা দাবি করছে যে এই স্থানটি হামাস তাদের কমান্ড সেন্টার হিসাবে ব্যবহার করতো। এজন্য ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে ২৬শে মার্চ ২০২৪ সালের মধ্যে গাজার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামে রেফারেন্সিং টানেল নিয়ে আইডিএফ এর সমস্ত বার্তা পর্যালোচনা করেছে। এর মধ্যে ১৯৮টি বার্তায় সুড়ঙ্গ খুঁজে পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি তারা টানেল এবং টানেল শ্যাফট অর্থাৎ টানেলের বাইরের মুখের সন্ধান পেয়েছে। আরও ১৪১টি বার্তায় দাবি করা হয়েছে যে আইডিএফ একটি টানেল ধ্বংস বা গুড়িয়ে ফেলেছে। তাদের বেশিরভাগই সুনির্দিষ্ট বিশদ বিবরণ বা নির্দিষ্ট অবস্থান দেয়নি। তাই আইডিএফ যে নেটওয়ার্কটি উন্মোচিত করেছে বা ধ্বংস করেছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। ইসরায়েলের হামলার চড়া মূল্য ইসরায়েলের হামলার কারণে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিশাল মূল্য দিতে হয়েছে। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এতে ৩৩ হাজারেও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ৫ই এপ্রিল থেকে মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব থেকে জানা যায় যে, নিহতদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি নারী ও শিশু। ইসরায়েলি বাহিনী হামাসের অবকাঠামো ধ্বংস করার চেষ্টা করায় আরও অনেকে বাস্তুচ্যুত এবং গৃহহীন হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ১৭ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আবাসিক এলাকাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, রাস্তাঘাট ধ্বংসস্তূপে জমে আটকে গিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং কৃষিজমিগুলো এবড়ো খেবড়ো হয়ে আছে। স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৭ই অক্টোবর থেকে গাজার ৫৬ শতাংশেরও বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই যুদ্ধ শুরু হওয়ার ছয় মাস পরেও এই যুদ্ধে ইসরায়েলের লক্ষ্য পূরণ করেছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। এটাও যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন ৬ | মাসে | হামাসকে | কতটুকু | ধ্বংস | করতে | পেরেছে | ইসরায়েল