গেল আগস্টে বাংলাদেশে রচিত হলো এক কালজয়ী ইতিহাস। একদল যুবকের প্রত্যয় আর দৃঢ়তার কাছে মাথানত করতে বাধ্য হয়েছে দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্র। পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে স্বৈরাচার শাসক গোষ্ঠী।
নিজেদের জীবন দিয়ে তারা রক্ষা করেছে দেশকে। সেই তেজদিপ্ত সংগ্রামী যুবকদের তোপে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে স্বৈরশাসক।
গল্পটা এক সাহসী সংগ্রামের। সেই গল্প শুনেছে সিরিয়ার সাধারণ মানুষ। যে গল্পে উজ্জবিত হয়ে তারা রুখে দাঁড়িয়েছে সেদেশের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। ভীত নড়িয়ে দিয়েছে সিরিয়ানদের বুকে জগদ্দাল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈর শাসকের। জনগণের একতাবদ্ধ প্রতিবাদ ও সংগ্রাম যেন এক অমোঘ শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে।
২০২৪ সালের বাংলাদেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সিরিয়ার বাতাসেও সেই একই সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটছে—একই রকম বিপ্লবের আভাস।
শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী যিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দেশের শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল এবং ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত।
শেখ হাসিনার শাসনকালে তার শাসনকালে দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতার সংকোচন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। এসব কারনে অসন্তুষ্ট জনগণ রুখে দাঁড়ায়। সেই রুখে দাঁড়ানো ২০২৪ সালে রূপ নেয় এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান।
প্রায় একই গল্প সিরিয়ার সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদেরও। দীর্ঘ ২৪ বছর একনায়কতন্ত্র চালিয়েছেন তিনি। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন আসাদ। তার আগে ১৯৭০ সালে তার বাবা হাফিজ আল আসাদ সিরিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বাসার আল আসাদের শাসনকাল শুরু হয় তার পিতা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর। ক্ষমতা পেয়ে ধীরে ধীরে একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন বাশার।
বিতর্কিত বাশারের শাসনকালে ২০১১ সালে সিরিয়ায় আরব বসন্তের প্রভাব পড়ে। তখন জনগণ রাজনৈতিক মুক্তির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলন দমনে বাশার সরকার কঠোর দমন-পীড়ন শুরু করে। সেই ক্ষোভ থেকে সিরিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
এ কারণে দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ধ্বংস হয়ে যায়। আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা একের পর এক অঞ্চল দখল করতে থাকে। তবে রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তায় কিছুটা শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম হন বাশার।
কিন্ত ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অভুথ্যানের গল্প শোনার পর উদ্দিপ্ত সিরিয়ানদের আর দমিয়ে রাখতে পারেননি বাশার। বাংলা বসন্তের বাতাসে দীর্ঘ ১৩ বছর সিরিয়ানদের আন্দোলনের ষোলকলা পূর্ণ হয়। রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন বাশার।
ঠিক যেমনটি ঘটেছিল বাংলাদেশের মাটিতে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জনগণের ক্ষোভ উত্তাল হলে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। দীর্ঘদিন শোষিত এবং অত্যাচারিত জনতা পথে নেমে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। সেদিন জনতা শুধু স্বৈর শাসকের পতনই দেখেনি। দেখেছিল মুক্তির আনন্দ। এটি ছিল তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার উৎসব, এবং সেই দৃশ্যগুলো ইতিহাস হয়ে রয়ে যাবে। সেদিন শুধু সরকারের পতনই ঘটেনি, এটি ছিল গণতন্ত্রের জয়। জনসাধারণের ঐক্য ও শক্তি ছিল এখানে মূল চালিকা শক্তি। তাদের প্রতিবাদে শাসনব্যবস্থার সব প্রতীক ভেঙে পড়ে।
একই দিনে রাজধানীর বিজয় স্মরণী মোড়ে স্থাপিত দেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিৃকৃতি ভেঙে দেয় বিক্ষুব্ধরা।
অনেকেই শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়ে। বিক্ষুব্ধরা বিভিন্ন উপায়ে শেখ হাসিনার প্রতি তাদের ক্ষোভ ঝাড়ে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ক্ষেত্রেও।
২০২৪ সালে, জনগণের একতার ফলস্বরূপ, বাশারও তার শাসন ব্যবস্থা হারান এবং ৯ ডিসেম্বর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। একই দিনে সিরিয়ার জনগণও হাফিজ আল-আসাদ, যিনি সিরিয়ার একনায়ক শাসক ছিলেন, তার প্রতিকৃতি ভেঙে ফেলে।
সিরিয়ার জনগণ তার সরকারের পতন উদযাপন করে সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করে। সেখানে তারা বাশার আল-আসাদের শাসনের প্রতীকগুলি ধ্বংস করে। প্রথমে তারা আসাদের ছবি নামিয়ে ফেলে, এরপর সরকারের অন্যান্য সজ্জা ও প্রতীক ভেঙে দেয়। সরকারি দপ্তরের রেকর্ড ফাইলগুলোও ছিঁড়ে ফেলে।
আসাদের শাসনকাল ছিল সিরিয়ার ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়, যেখানে তার একনায়ক শাসন ও দমননীতি জনগণের মধ্যে বিরক্তি এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থান এবং তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ ও সিরিয়ার এই দুটি ঘটনাই স্মরণ করিয়ে দেয়, জনগণের শক্তি আর সংগ্রামের কাছে পৃথিবীর কোন অপশক্তিই টিকে থাকতে পারে না।
লেখক: অনন্যা চৈতী, গণমাধ্যম কর্মী