জাতীয়

বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন কবি হেলাল হাফিজ

বায়ান্ন প্রতিবেদন

প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ ছবি: সংগৃহীত ছবি

রাজধানীর  বাংলা একাডেমি ও জাতীয় প্রেসক্লাবে দ্বিতীয় ও শেষ নামাজে জানাজা শেষ মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরন্দ্রিায় শায়িত হলেন বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিক কবি হেলাল হাফিজ। শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টার দিকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।এর আগে, সকাল সাড়ে ১১টায় সাড়ে ১১টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চ প্রাঙ্গণে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। 

এসময় কবির পরিবার, ভক্ত-অনুরাগীসহ বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে বাদ জোহর কবি হেলাল হাফিজের দ্বিতীয় ও শেষ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত জাতীয় প্রেসক্লাবে।  সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কবির আত্মীয়-স্বজন ও ভক্ত-অনুরাগীসহ বিশিষ্টজনেরা। উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।

সংস্কৃতি উপদেষ্টা হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, মাত্র অল্প কিছু কবিতা দিয়েই হেলাল হাফিজ বাংলাভাষার উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ‍্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তার অবদান জাতি সবসময় স্মরণ করবে।

সংস্কৃতি উপদেষ্টা হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, মাত্র অল্প কিছু কবিতা দিয়েই হেলাল হাফিজ বাংলাভাষার উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ‍্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তার অবদান জাতি সবসময় স্মরণ করবে।

এর আগে, গেলো শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানী শাহবাগে অবস্থিত সুপার হোমের বাথরুমে পড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয় হেলাল হাফিজের। কর্তৃপক্ষ তাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

হেলাল হাফিজ দীর্ঘদিন ধরে গ্লুকোমায় আক্রান্ত ছিলেন। পাশাপাশি কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস ও স্নায়ু জটিলতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ: ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হেলাল হাফিজ।  প্রেম ও দ্রোহের  প্রতিভাবান এই কবি একদিকে  যেমন প্রেমিকদের যুদ্ধে নিতে উদ্ধুদ্ধ করেছেন।

অন্যদিকে ‘এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো/পত্র দিয়ো’- প্রেমিকার পত্র চেয়ে হাজারো প্রেমিকের প্রতিনিধি হয়ে আক্ষেপও করেছেন চিরকুমার এই কবি। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখবোধের গল্প তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। এজন্যই বোধ হয় ‘প্রতিমা’ কবিতায় কবি বলেছেন—শুনেছি সুখেই বেশ আছো,কিছু ভাঙচুর আর/তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল,টলম/অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে/মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়,বিরহে উজ্জ্বল।’

১৯৮৬ সালে নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়সহ ৫৫টি কবিতা মিলে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা কাব্যগ্রন্থটি বাংলাদেশের সর্বাধিক বিক্রিত কাব্যগ্রন্থ । কবিতাগুলো  ওই সময় তারুণদের মধ্যে জাগরণ তৈরি করে।  সহজ-সরল ভাষায় লেখা মানুষের হৃদয় আলোড়িত করা একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে হেলাল হাফিজ ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও আসামান্য খ্যাতি লাভ করেন। যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এ পর্যন্ত বইটির মুদ্রণ হয়েছে ৩৩বারেরও বেশি।

কবি হেলাল হাফিজ শুধু একজন কবি নয় বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম এবং সামাজিক বিপ্লবের প্রতীক। তার লেখা খুব অল্প হলেও প্রতিটি কবিতাই বাংলাদেশের সাহিত্য ভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ। তার লেখা ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’

—এই লাইনটি বাংলাদেশে প্রজন্মের চেতনাকে আন্দোলিত করে।’৮০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলেন সময় হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র  এই পঙক্তিটি উচ্চারিত হয় মিছিলে, স্লোগানে, কবিতাপ্রেমীদের মুখে মুখে।

লড়াইয়ে, সংগ্রামে, প্রেমে-বিরহে, দ্রোহে যাপিত জীবনের সব খানেই হেলাল হাফিজের কাব্যিক স্পর্শ পাওয়া যায়। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। এ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি/ সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে? জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে/ রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,/ তোমার দিকে চোখ ছিল না/ জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’ শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মতো প্রেক্ষাপটে নয়, যেকোনো অন্যায়ে-শোষণে-অবিচারে হেলাল হাফিজের এ উচ্চারণ সবার হয়ে ওঠে।

কবি হেলাল হাফিজ স্বল্প কথায় গভীর বক্তব্য দেওয়ার জন্য বাংলা সাহিত্যে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলেও মনে করছেন এই অঙ্গনের মানুষেরা। লেখালেখির পাশাপাশি হেলাল হাফিজ দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন পত্রিকায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেন। প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল  হাফিজ ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

এমআর//