আন্তর্জাতিক

মানবদেহে সফলভাবে শুকরের লিভার প্রতিস্থাপন

বায়ান্ন প্রতিবেদন

চীনের চিকিৎসকরা প্রথমবারের মতো জিনগতভাবে পরিবর্তিত একটি শুকরের লিভার সফলভাবে মস্তিষ্ক-মৃত (ব্রেন-ডেড) এক মানবদেহে প্রতিস্থাপন করেছেন। বুধবার (২৬ মার্চ) এই সাফল্যের ঘোষণা দিয়ে তারা জানিয়েছেন, এটি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অগ্রগতি।

বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সিএনএন’র প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে লিভার দাতার সংকট মোকাবিলায় এই গবেষণা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই অর্জন ভবিষ্যতে মানবদেহে প্রাণীর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পথে আরও উন্নত প্রযুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য শুকরকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক বছরে কয়েকজন জীবিত রোগীর শরীরে সফলভাবে শুকরের কিডনি ও হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তবে লিভার প্রতিস্থাপন তুলনামূলকভাবে আরও জটিল, এবং এটি আগে কখনো কোনো মানবদেহে পরীক্ষা করা হয়নি।

বিশ্বজুড়ে লিভার প্রতিস্থাপনের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। গবেষকরা আশা করছেন, জিনগতভাবে সম্পাদিত শুকরের লিভার অন্তত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য একটি সাময়িক সমাধান হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

চীনের শিয়ানের চতুর্থ সামরিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা এই গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের গবেষণা প্রখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ন্যাচার-এ প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম শুকরের লিভার মানবদেহে প্রতিস্থাপন

এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১০ মার্চ চীনের একটি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো জিনগতভাবে পরিবর্তিত একটি শুকরের লিভার এক মস্তিষ্ক-মৃত (ব্রেন-ডেড) প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। লিভারটি ছয়টি জিন সম্পাদনার মাধ্যমে মানবদেহের উপযোগী করা হয়েছিল।

এই ট্রায়াল ১০ দিন পর রোগীর পরিবারের অনুরোধে বন্ধ করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পুরো প্রক্রিয়াটি কঠোর নৈতিক নির্দেশনার আওতায় পরিচালিত হয়েছে।

‘ব্রিজ অর্গান’ হিসেবে শুকরের লিভার ব্যবহার

গবেষণায় অংশ নেয়া রোগীর আসল লিভার তার শরীরেই বহাল ছিল। তবে শুকরের লিভারকে 'ব্রিজ অর্গান' হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যা বিদ্যমান লিভারের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে এবং রোগীদের মানব লিভার দানের জন্য অপেক্ষার সুযোগ করে দিতে পারে।

১০ দিন ধরে চিকিৎসকরা প্রতিস্থাপিত লিভারের রক্তপ্রবাহ, পিত্ত উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন।

গবেষণার সহ-লেখক ও শিয়ান হাসপাতালের চিকিৎসক লিন ওয়াং এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রতিস্থাপিত শুকরের লিভার অত্যন্ত ভালোভাবে কাজ করেছে। এটি স্বাভাবিকভাবে পিত্ত নিঃসরণ করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন অ্যালবুমিন উৎপাদন করেছে। গবেষকরা মনে করছেন, এটি ভবিষ্যতে লিভার প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে কাজ করতে পারে।

সতর্কতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিশেষজ্ঞরা এই গবেষণাকে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন, তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন যে, এটি এখনই মানব লিভারের সম্পূর্ণ কার্যকর বিকল্প হতে পারে না।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পিটার ফ্রেন্ড গবেষণাটিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি মনে করেন, শুকরের লিভার প্রতিস্থাপন এখনো মানবদেহে সম্পূর্ণ কার্যকর সমাধান নয়, বরং ভবিষ্যতে লিভার বিকল রোগীদের জন্য এটি একটি সহায়ক পদ্ধতি হতে পারে।

চীনা গবেষকরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে তারা জীবিত রোগীদের শরীরে জিনগতভাবে পরিবর্তিত শুকরের লিভার প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা করছেন।

এর আগে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এক মস্তিষ্ক-মৃত রোগীর শরীরে শুকরের লিভার সংযুক্ত করেছিলেন, তবে সেটি শরীরের ভেতরে প্রতিস্থাপন না করে বাহ্যিকভাবে সংযুক্ত রাখা হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে শুকরের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপিত দুই রোগী শেষ পর্যন্ত মারা গেলেও, ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর টোয়ানা লুনি নামের ৫৩ বছর বয়সি এক নারী শুকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

চিকিৎসক লিন ওয়াং স্বীকার করেছেন যে, এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকদের গবেষণা ও অভিজ্ঞতা থেকে চীনা গবেষকরা অনেক কিছু শিখেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সাফল্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তবে এটি পুরোপুরি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করতে আরও গবেষণা ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

 

এসি//

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন শুকরের লিভার | চীন