শ্রাবণের আকাশ আজও ভারি। বৃষ্টির ধারা যেন এক অবিরাম শোকগাথা গেয়ে চলে। আজ ২২ শ্রাবণ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮৪তম মহাপ্রয়াণ দিবস। তবে এ মৃত্যু নয় নিঃশেষতা, বরং এক নতুন অস্তিত্বের উদয়। কেননা তিনি চলে যাননি, রয়ে গেছেন প্রতিটি বাঙালির জীবনদর্শন, প্রেম, প্রতিবাদ ও আত্মদর্শনের প্রতিটি পরতে। শ্রাবণের বর্ষণে যিনি গেছেন ‘না ফেরার দেশে’, তার গান আজও ফিরে আসে নতুন দিনের আলো হয়ে।
রবীন্দ্রনাথ কোনো বিশেষ ধর্ম, গোষ্ঠী কিংবা শ্রেণির কবি ছিলেন না—তিনি ছিলেন মানবতার কবি। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান—সব মতের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি বলেছিলেন, “প্যাট্রিওটিজম ক্যান নট বি আওয়ার ফাইনাল স্পিরিচুয়াল শেল্টার; মাই রিফিউজ ইজ হিউম্যানিটি।” তাই তার সাহিত্যকর্মে যতটা দেশ, তার চেয়েও বেশি মনুষ্যত্ব, তার চেয়ে বেশি জীবন।
রবীন্দ্রনাথের রচনার উল্লেখযোগ্য অংশই রচিত হয়েছে পূর্ববাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে ঘিরে। পদ্মা-গড়াইয়ের ঢেউ, কুষ্টিয়া-শিলাইদহের প্রান্তর, চলনবিলের জলরাশি কিংবা নাগর নদীর কূলে বসে জন্ম নিয়েছে ‘সোনার তরী’, ‘বিসর্জন’, কিংবা ভাটিয়ালি সুরে ভরপুর গান।
নওগাঁর পতিসর, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন না শুধুই ভূমির—তিনি ছিলেন হৃদয়ের জমিদার। পতিসর ছিল তার আদর্শ গ্রামের রূপকার, যেখানে তিনি গড়েছিলেন রাস্তা, স্কুল, চিকিৎসাকেন্দ্র, রেশম প্রকল্প ও কৃষি ব্যাংক। নোবেল পুরস্কারে পাওয়া এক লাখ আট হাজার টাকা তিনি পতিসর কৃষি ব্যাংকে দান করেছিলেন।
কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কাটানো সময় তার কবিসত্তাকে বিকশিত করেছিল নতুনভাবে। এখানকার প্রকৃতি, নদী, কৃষক, কীর্তন, জারি, সারি, ভাটিয়ালি—সব মিলিয়ে তৈরি করেছিল তার গানের নতুন স্বরলিপি।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’—এই গানে রবীন্দ্রনাথ শুধু দেশের প্রেমে ডুবে যাননি, বাংলাদেশের প্রতিটি মৌসুম, প্রতিটি রঙ, প্রতিটি নিঃশ্বাস-নিসর্গকে অন্তরে ধারণ করেছেন। গানটির সুর নিয়েছেন গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গান থেকে—যা নিজেই বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির প্রতীক।
১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি প্রথম চিত্রায়িত হয়। আর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আগ মুহূর্তে, রেসকোর্স ময়দানে উচ্চারিত হয় এই গান—যা হয়ে ওঠে স্বাধীনতার আগুনের আগুনঝরা সুর। পরবর্তীতে এই গানই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়।
তার কাব্যগ্রন্থ, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প—সব কিছুতেই ফুটে উঠেছে সত্য-সুন্দর-প্রেম-বেদনার দোলাচল।
৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও ৯৫টি ছোটগল্প—সবই আজও সমান জনপ্রিয়। দুই হাজারের বেশি গান যেন জীবনের প্রতিটি অনুভূতির ভাষ্যকার। আর শেষ বয়সে তাঁর আঁকা চিত্রকর্মগুলো হয়ে উঠেছে একেকটি বিমূর্ত আত্মপ্রকাশের নিদর্শন।
“বিশ্বকবি” অভিধাটি শুধুই ভৌগোলিক পরিসরে নয়, কালিক অর্থেও প্রযোজ্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে খুঁজে পায় সাহিত্যে, সুরে, বর্ণে, ভাষায়।
আবু রুশদি একবার লিখেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথকে বারবার পড়লে বারবার নতুন করে পাওয়া যায়।” এবং তাতেই প্রমাণ হয়—তিনি কেবল কবি নন, তিনি সময়ের চিরন্তন ব্যাখ্যাতা।
মহাকালের পথে প্রতিবছর ফিরে আসে ২২ শ্রাবণ। মনে পড়ে যায় সেই অমোঘ উচ্চারণ:
“আমারে দেব না ভুলিতে”।
রবীন্দ্রনাথ নেই—এই সত্য নয়। বরং প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি সুরে, প্রতিটি হৃদয়ে তিনি আছেন, থাকবেন... চিরকাল।
এসি//