মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চার বছর শেষ হচ্ছে আজ বুধবার (২৫ আগস্ট)। ২০১৭ সালের আগস্টের মাঝামাঝিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সেনাবাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হয়। এরপর ২৫ আগস্ট থেকে দলে দলে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করেন। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে ঢল নামে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের। মানবিক বিবেচনায় তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ সুবিধা পেতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উখিয়া-টেকনাফে ঢুকতে থাকেন রোহিঙ্গারা। নৌ পথে বাংলাদেশে ঢুকতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে মারা যান প্রায় তিন শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ উপকূলে একে একে ভেসে আসতে থাকে রোহিঙ্গাদের লাশ।
নির্মম নির্যাতনের শিকার অনেক রোহিঙ্গাকে দেখে স্থানীয়রাও এগিয়ে আসেন তাদের সহায়তায়। খাবার থেকে শুরু করে যে যেমন পেরেছেন সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন তাদের দিকে। যা প্রশংসিত করেছে তাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বড় বড় এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসে রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্প তৈরি করে। উখিয়া-টেকনাফের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার একর ভূমিতে ৩৪টি ক্যাম্পে ভাগ হয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা। যা বাংলাদেশকে প্রশংসিত করেছে বিশ্ব দরবারে।
তবে দীর্ঘ চার বছরেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট হিসেবে স্বীকৃত রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীন ভূমিকায় এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা।
জানা গেছে, গত বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। চাপের মুখে একপর্যায়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মতি জানায়। পর পর দুই বার প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। তবে এ আলোচনা কোনো ধরণের আলোর মুখ দেখেনি। তারপরও দুই বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সব প্রস্তুতি নিয়েও তা শুরু করা যায়নি। তার পেছনে কিছু এনজিও সংস্থার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণাকে দায়ী করেছেন স্থানীয়রা।
এতকিছুর পর কী পেয়েছে বাংলাদেশিরা? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই উঠে আসবে ভয়াবহ এক চিত্র। যার মধ্যে রয়েছে নিজেদের জমির ওপর যাদের আশ্রয় দিয়েছেন সেসব রোহিঙ্গারা এখন তাদের অপহরণ ও হত্যা করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গারাদের বেপরোয়া আচরণে এখন আতঙ্কিত উখিয়া-টেকনাফবাসী।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের সবুজ পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ঘর তৈরির জন্য কেটে ফেলা হয়েছে পাহাড়ি ছোট-বড় অসংখ্য গাছপালা। এক সময়ের সবুজ পাহাড় এখন বৃক্ষশূন্য। ফলে সেখানে পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। পাহাড়ে রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করায় হাতির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্রও বিনষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের রান্নার কাজে ছয় হাজার ৮০০ টন জ্বালানি কাঠ প্রয়োজন। রোহিঙ্গারা স্থানীয় পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকেই ওই কাঠ সংগ্রহ করে। তবে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহের মাধ্যমে সে সংকট থেকে উঠে এসেছে বন বিভাগ। ক্যাম্পের অভ্যন্তরেই লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ বিভিন্ন গাছের চারা। তাতেই সবুজের আবহ শুরু হয়েছে ৩৪টি ক্যাম্পে।
এদিকে চার বছরেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় ক্ষুব্ধ জেলার রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া নিয়েও ক্ষোভ আছে তাদের মধ্যে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারের অনীহা এবং দেশি-বিদেশি কতিপয় এনজিও ও সন্ত্রাসী গ্রুপের ইন্ধনে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জোরদার করার দাবিতে বুধবার (২৫ আগস্ট) সকালে কক্সবাজার পৌরসভা ভবন চত্বরে গণসমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা এখন মাদক, সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে প্রায় মারামারি, খুনখারাবিতে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। স্থানীয়দের ওপরও হামলা চালাচ্ছে তারা। ইয়াবার টাকায় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে চুরি-ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণের ঘটনায় লিপ্ত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। জেলার শ্রমবাজারও অনেকটা রোহিঙ্গাদের দখলে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, মানবিক কারণে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হলেও তারা নানা অপরাধকর্ম, মাদক চোরাচালান, খুনখারাবিতে জড়িয়ে পড়েছে। ক্যাম্প ছেড়ে লাখো রোহিঙ্গা দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। যা দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজোয়ান হায়াত বলেন, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। রোহিঙ্গারাও অনেকে প্রস্তুত প্রত্যাবাসনের জন্য। যখনই নির্দেশনা আসবে আমরা তা বাস্তবায়ন করবো।
২৫ আগস্ট ক্যাম্পে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেক বছর রোহিঙ্গারা এই দিনে প্রোগ্রাম করে। তারা এবারও আবেদন করেছিল, আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে অনুমতি দেইনি।
প্রসঙ্গত , ১৯৮০ দশকে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরের শুরুর দিকে ধাপে ধাপে সামরিক প্রচারণা চালিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী করে তোলা হয়। এরপর ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা ও স্থানীয় মগদের নির্যাতন শুরু হয়। ওই দিন থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশে এসেছিল রোহিঙ্গারা। এর আগেও ১৯৭৮ ও ১৯২ সালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে যারা বাংলাদেশে আসে তাদের কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় দুইটি ক্যাম্প রাখা হয়।
কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আবারও নিপীড়নেরমুখে বাংলাদেশে আসতে হয় রোহিঙ্গাদের। এ সময় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নতুন পুরাতন মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ।
মুক্তা মাহমুদ