আন্তর্জাতিক

আল জাজিরার প্রতিবেদন

ভারত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পুরোনো বন্ধু আফগানিস্তান, সতর্কতার সহিত নজর রাখছে পাকিস্তান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২০২১ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে তালেবান। সেসময় তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, আফগানরা দাসত্বের শিকল ভেঙ্গে ফেলেছে। তালেবানের এই ক্ষমতাগ্রহণকে গোষ্ঠীটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের আঞ্চলিক শক্তি বৃদ্ধিরও একটি কার্যকরী নিয়ামক হিসেবে দেখা হচ্ছিলো।  

এছাড়া তালেবানের মাধ্যমে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের ওপর কৌশলগত প্রভাব ধরে রাখার মাধ্যমে চিরপ্রতিদ্বন্দী দিল্লিকে শায়েস্তা করার একটা সুযোগ পায়। তবে তিনবছর পর ২০২৪ সালে এসে পাকিস্তানের সেই হিসাবনিকাশ অনেকটাই উল্টে গেছে

গেলো সপ্তাহে দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন। গেলো কয়েক বছরের মধ্যে নয়া দিল্লি ও তালেবানের কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে এটিই প্রথম কোন বৈঠক। এই বৈঠকের পর দেশ দুটি বেশ কিছু গুরুত্বপুর্ণ পদক্ষেপ নেয়, যেটিকে কাবুল ও দিল্লির মধ্যে কয়েক বছর ধরে চলে আসা অবিশ্বাস ও শত্রুতার অবসান ঘটানোর নাটকীয় মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। 

তালেবানের সঙ্গে ভারতের এই সখ্যতা যদি বেড়ে যায়, তাহলে তা ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করা পোর্টাল দ্য খোরাশান ডায়েরীর সহপ্রতিষ্ঠাতা ইফতিখার ফিরদৌস। তিনি বলেন, দিনশেষে ভারত-পাকিস্তানের এই স্নায়ুযুদ্ধের ভুক্তভোগী হবে পাকিস্তানের সীমান্তের ওপর নির্ভর করা আফগানরা

পুরোনো বন্ধু, নতুন সহযোগী

১৯৮০ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের সমর্থন দিয়ে আসা থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই যুগ- তালেবানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছে পাকিস্তান। সংগঠনটির অনেক নেতা পাকিস্তানের মাটিতেও আশ্রয় নিয়েছে

অন্যদিকে সংগঠনটিকে পাকিস্তানের প্রক্সি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৬ সালে তালেবান যখন প্রথম আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তখন ভারত  কাবুলে থাকা তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে থাকা ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে হামলার জন্য তালেবানের পাশাপাশি তাদের প্রধান মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠী হাক্কানিকে দায়ী করে দিল্লি। এছাড়া ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আফগানিস্তানের জালাবাদ, হেরাত ও মাজার-ই-শরীফ থাকা ভারতীয় কনস্যুলেটে হামলার জন্যও তালেবান ও হাক্কানিকে দায়ী করে দিল্লি। তবে এক দশক পরে ওইসব ঘটনা বা হিসেবনিকেশ এখন আর ভারত আফগানিস্তানের সম্পর্কে খুব বেশি বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে না।        

এর পরে ২০১৬ সালের পর পাকিস্তানের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বড় রকমের হামলার ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালে। এসব হামলার পিছনে আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয়া পাকিস্তানভিত্তিক তেহরিক-ই-তালেবান, টিটিপিকে দায়ী করে গেলো ডিসেম্বরে হামলা চালায় ইসলামাবাদ। বিমান হামলার জেরে দেশ দুটি একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের এই সম্পর্কের অবনতির সুযোগে কাবুলের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ায় দিল্লি। 

২০২৪ সালের নভেম্বরে কাবুলে দেশ দুটির মধ্যে একটি গুরুত্বপুর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরান নিয়ে কাজ করা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জেপি সিং ও আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মুল্লাহ মোহাম্মদ ইয়াকুবের মধ্যে এই বৈঠক হয়।  

বৈঠকের এক সপ্তাহ পর- ভারতের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পাওয়া সত্ত্বেও তালেবান সরকার  আফগানিস্তানের দূত হিসেবে ইকরামুদ্দিন কামিলকে দিল্লিতে নিয়োগ দেয়। আর গেলো সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকির বৈঠকের পর আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতকে ‘গুরুত্বপুর্ণ আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক সহযোগী’ হিসেবে অভিহিত করে।   

তবে পাকিস্তানি কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ইসলামাবাদের আপাতত চিন্তার কোন কারণ নেই। আফগানিস্তানে নিযুক্ত পাকিস্তানের বিশেষ প্রতিনিধি আসিফ ডুরানি বলেন, সম্পর্কের মাত্রার ক্ষেত্রে নিউ দিল্লি ও কাবুলের চেয়ে পাকিস্তান ও কাবুলের মধ্যেকার সম্পর্ক বেশি গভীর। ‘ তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারত আফগানিস্তান ছেড়ে গিয়েছিলো। এখন ব্যবসার খাতিরে তারা আবারও আফগানিস্তানে ফিরে আসছে। ভারত ও আফগানিস্তান উভয়ই সার্বভৌম রাষ্ট্র। তারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। আর যতক্ষণ না তাদের এই সম্পর্ক পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামাবাদ প্রতিবাদ জানাবে না

জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধীও একই কথা বলেন। পাহাড়া ঘেরা আফগানিস্তান ব্যবসা ও ট্রানজিটের জন্য মূলত পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করে। ভারতের সঙ্গে কাবুলের ঘনিষ্ঠতা এই ভৌগোলিক অবস্থানে পরিবর্তন আনবে না

তবে আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান পরিবর্তন না হলেও অন্যকিছু অনেক পরিবর্তন হয়েছে।  

গত দুই যুগে ভারত যখন আফগানিস্তানে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে, তখন আফগান সরকারের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম পাকিস্তানি সীমান্ত, যেখানে তেহরিক-ই-তালেবানের হামলা নিয়ে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। ২০০৭ সালে তেহরিক-ই-তালেবানেটিটিপি প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটি আদর্শগতভাবে আফগান তালেবানের অনুসারীতথ্যমতেগেলো বছর পাকিস্তানে ছয়শ’র মত সন্ত্রাসী হামলা হয়। এতে মারা যায় ১৬০০ জন। এর মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আছে ৭০০। এসব হামলার বেশির ভাগের দায় স্বীকার করেছে টিটিপি। 

ইরানের চাবাহার বন্দর

মিশ্রির সঙ্গে মুত্তাকির বৈঠকের পর আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছেতারা চাবাহার বন্দর ব্যবহার করে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ করতে চায়। এর মাধ্যমে দেশটি পণ্য আনা নেয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারবে।  

চাবাহার বন্দর ইরানের সিস্তান-বালুচেস্তান প্রদেশে অবস্থিত। বন্দরটি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ ঘেঁষা। বিভিন্ন সম্পদে পরিপুর্ণ বেলুচিস্তান প্রদেশে পাকিস্তান অনেক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অনেকেই ইরানে আশ্রয় নিয়েছে

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইরান বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীদের লক্ষ্য করে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে হামলা চালায় তেহরান। পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালায়। হামলা পাল্টা হামলার পর ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা কমে যায়। তবে ইসলামাবাদ বালুচদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে উসকানি দেয়ার অভিযোগে ভারতকে দায়ী করে

২০১৬ গ্রেপ্তার করা কুলবুশন যাদবকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি পাকিস্তান সেসময় উল্লেখ করে। বেলুচিস্তানে গুপ্তচরবৃত্তি করার অভিযোগে যাদবকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান। তবে ভারত এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে দাবি করেযাদবকে ইরান থেকে অপহরণ করা হয়েছিলো

এসব ঘটনা পিছনে ফেলে দিলেওচাবাহার বন্দর ও এটি ঘিরে আফগানিস্তান-ভারতের বাণিজ্য পাকিস্তানের কাছে হস্তক্ষেপবাদ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে জানান বিশেষজ্ঞ ফিরদৌস

 

এনএস/   

 

  

 

 

 

 

 

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন আফগানিস্তান