আজকাল অনেক মেয়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে নানা কষ্টে ভোগেন। তবে এমন অনেক লাজুক মেয়ে রয়েছেন যারা নিজের সমস্যা সঠিকভাবে ব্যক্ত করতে পারেন না। এই কারণে তাদের ছোটখাটো সমস্যা ক্রমে বড় আকার ধারণ করতে পারে। বর্তমান সময়ে বিশ্বের বহু কিশোরী এমন শারীরিক সমস্যার শিকার হচ্ছেন, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এই সমস্যা হচ্ছে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS)।
পিসিওএস এক ধরনের হরমোনাল সমস্যা, যা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের মধ্যে দেখা যায়। তবে সম্প্রতি কিশোরীদের মধ্যেও এর প্রবণতা বেড়েছে। এখনকার দিনে এই সমস্যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এটি কিশোরীদের স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
পিসিওএস একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে ডিম্বাশয়ের মধ্যে ছোট ছোট সিস্ট (fluid-filled sacs) তৈরি হয়, যা প্রজনন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। এই সমস্যা মূলত হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়। যার ফলে মেয়েরা অস্বাভাবিক মাসিক চক্র, অতিরিক্ত লোম বৃদ্ধি, ওজন বৃদ্ধি, এবং কখনও কখনও গর্ভধারণে সমস্যা অনুভব করতে পারে। এছাড়া, মনোবিদ্যার দিক থেকে, এই অবস্থার কারণে অনেক কিশোরীর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব, উদ্বেগ, এবং হতাশা দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এই সমস্যা যতটা সহজে ধরা পড়ে, ততটাই সাধারণত মেয়েরা এর দিকে নজর দেন না। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা না নেওয়া হলে পিসিওএস দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।
যেহেতু পিসিওএস হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়,এটি শরীরের নানা অংশে প্রভাব ফেলতে পারে। কিশোরীদের ক্ষেত্রে সাধারণত মাসিক চক্রে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, অতিরিক্ত ওজন বাড়ে, এবং মুখ ও শরীরে লোমের পরিমাণ বাড়তে পারে। এগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানসিক অবস্থা যেমন হতাশা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং অবসাদ তৈরি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, কোনও শারীরিক সমস্যার জন্য লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এগুলো সুস্থভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে পিসিওএস সময়মতও সঠিক চিকিৎসা না হলে এটি গর্ভধারণে সমস্যা, হৃদরোগ, এবং ডায়াবেটিস ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় অব ক্যালিফোর্নিয়ার চিকিৎসাবিজ্ঞানী ড. লুসি টেইলর বলেন,পিসিওএস একটি জটিল হরমোনাল সমস্যা, যা কিশোরীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও শারীরিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করতে পারে। হরমোনের অস্বাভাবিকতা, বিশেষত ইনসুলিন রেজিস্টেন্স (insulin resistance) এবং উচ্চ মাত্রার এন্ড্রোজেন (পুরুষ হরমোন) এর কারণে এটি ঘটে। এই কারণে পিসিওএস সাধারণত গর্ভধারণে সমস্যা সৃষ্টি করে, পাশাপাশি শরীরের নানা পরিবর্তন যেমন অতিরিক্ত লোম বৃদ্ধি বা ত্বকের সমস্যা দেখা দেয়।
পিসিওএসের সঠিক কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। তবে বেশ কিছু গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, জিনগত এবং পরিবেশগত কিছু ফ্যাক্টর এর জন্য দায়ী।
একজন বিশেষজ্ঞ গাইনোকোলজিস্ট ড. সারা জোন্স জানান, পিসিওএসের জন্য মূলত জেনেটিক প্রভাব এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন দায়ী। পরিবারের ইতিহাস থাকলে এই সমস্যার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এমনকি অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক অক্ষমতা এবং মানসিক চাপও পিসিওএসের কারণ হতে পারে।
এছাড়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল’ এর এক বিশেষজ্ঞ ড. মাইকেল জনসন জানিয়েছেন, ইনসুলিন রেজিস্টেন্স পিসিওএসের অন্যতম প্রধান কারণ। এটি শরীরের ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, যা ডিম্বাশয়ে সিস্ট তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
কিশোরীদের মধ্যে পিসিওএস দীর্ঘমেয়াদী গর্ভধারণের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি এটি অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যারও ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এবং হাইপারটেনশন। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. অ্যামি হ্যানসন বলেন,যদি পিসিওএস যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তবে এটি বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। কিছু কিশোরীর ক্ষেত্রে এটি সারা জীবনের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
এছাড়া পিসিওএসের মানসিক প্রভাবও অনেক গুরুতর হতে পারে। অতিরিক্ত হরমোনের কারণে কিশোরীদের মধ্যে চুল পড়া, ত্বকের সমস্যা (যেমন পিম্পলস) এবং অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। এতে আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং অবসাদ তৈরি হয়, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
পিসিওএসের চিকিৎসা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না হলেও, এর প্রভাব কমানো সম্ভব। পিসিওএসের জন্য সাধারণত চিকিৎসকরা হরমোনাল থেরাপি অথবা ইনসুলিন লেভেল নিয়ন্ত্রণের জন্য মেডিটেশন প্রদান করেন। এছাড়া লাইফস্টাইল পরিবর্তন যেমন সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানো। এছাড়া কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ যেমন মেটফর্মিন এবং বিরোধী এন্ড্রোজেন চিকিৎসা কিশোরীদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
ড. লুসি টেইলর আরও বলেন, কিশোরীদের জন্য পিসিওএসের চিকিৎসায় প্রথমে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীতে যদি প্রয়োজন হয় তবে চিকিৎসার মাধ্যমে সঠিক হরমোনের ভারসাম্য সাধন করতে হবে।
এছাড়া কিছু কিশোরী ডায়েট এবং ফিটনেস প্ল্যান মেনে চললে তাদের শারীরিক অবস্থা অনেকটাই উন্নতি হতে পারে, যার মাধ্যমে হরমোনের ভারসাম্য আরও সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বর্তমানে পিসিওএসের বিষয়ে অনেক কিশোরী এবং তাদের পরিবার সচেতন নয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পিসিওএসের লক্ষণ ও চিকিৎসার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর খুবই প্রয়োজন।
ড. সারা জোন্স বলেন, পিসিওএস নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে কিশোরীরা খুব সহজেই এই সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণগুলো চিনতে পারবে এবং যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
কিশোরীদের মধ্যে পিসিওএস একটি গুরুত্বপূৰ্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকতে পারে। সঠিক চিকিৎসা, সচেতনতা এবং জীবনযাত্রার উন্নতি এই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পিসিওএস সম্পর্কিত সঠিক তথ্য জানা এবং সময়মতও চিকিৎসা নেওয়া কিশোরীদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।
এসকে//