সকালের অ্যালার্ম শুনেও যদি মনে হয়, ‘আর পাঁচ মিনিট!’, অফিস বা ক্লাসের মাঝেও যদি ঘুম এসে চোখে ঝাপসা করে, আর ঘন ঘন হাই তোলার জন্য সহকর্মীরা হাসাহাসি করে—তাহলে আপনি একা নন! অনেকেই এমন সমস্যায় ভোগেন, কিন্তু জানেন কি? এটা শুধুই আলস্য নয়, হতে পারে হাইপারসমনিয়া নামের এক ঘুমকাতুরে সমস্যা!
দিনের বেলা ঘুম পাওয়া মানেই যে রাতে ঘুম ঠিকঠাক হয়নি, তা কিন্তু নয়। এমনকি ১০-১১ ঘণ্টা ঘুমিয়েও যদি বিছানার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে ঘুমের ব্যাপারে একটু সিরিয়াস হওয়ার সময় এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমন হয়? আর এর থেকে মুক্তির উপায় কী? চলুন খুঁজে বের করি ঘুমপাগল হওয়ার রহস্য!
সারা দিন ক্লান্তি লাগা, ঝিমুনি আসা, মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, কাজের মাঝেই হাই উঠতে থাকা—এসব লক্ষণ সাধারণ মনে হলেও, এটি হতে পারে হাইপারসমনিয়া নামের একটি ঘুমজনিত সমস্যা।
‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন’ (NCBI)-এর তথ্যানুসারে, বিশ্বের প্রায় ৪-৬% মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন। এটি এমন এক শারীরিক অবস্থা, যেখানে ৮-১০ ঘণ্টা ঘুমানোর পরেও সারাদিন ঘুম পায়, মাথা ভার ভার লাগে, ক্লান্ত লাগে এবং কাজের প্রতি উৎসাহ কমে যায়।
দুঃখের বিষয় হলো, এই সমস্যার কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই। তবে কিছু ভালো অভ্যাস গড়ে তুললে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
যেভাবে বুঝবেন আপনি হাইপারসমনিয়ায় আক্রান্ত-
আপনার মধ্যে যদি নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়, তাহলে এটি হাইপারসমনিয়ার ইঙ্গিত হতে পারে-
রাতে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েও ক্লান্ত লাগে। টানা ১০-১১ ঘণ্টা ঘুমানোর পরেও মনে হয়, আরও কিছুক্ষণ ঘুমালে ভালো লাগত!
ঘন ঘন হাই ওঠে ও ঝিমুনি আসে। দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুম পায়, কাজের মাঝেও চোখ বুজে আসছে।
মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ক্লান্তির পাশাপাশি মেজাজ খারাপ থাকে, উদ্বেগ বা হতাশা বাড়তে পারে।
সকালে মাথা ভার লাগে। মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
ভুলে যাওয়া ও মনোযোগের অভাব। কিছুদিন ধরে মনে রাখার ক্ষমতা কমে গেছে কিংবা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে।
চোখ ব্যথা করছে, জ্বালা করছে বা চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ে।
এগুলো যদি নিয়মিত হতে থাকে, তাহলে সতর্ক হওয়া জরুরি!
হাইপারসমনিয়ার কারণ -
এনসিবিআই-এর তথ্যানুসারে, বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণে হাইপারসমনিয়া হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো—
স্লিপিং ডিজঅর্ডার:
রাতে ভালো ঘুম না হলে (যেমন: ইনসমনিয়া বা স্লিপ অ্যাপনিয়া) দিনের বেলা ঝিমুনি আসতে পারে।
মানসিক সমস্যা:
দীর্ঘদিনের স্ট্রেস, ডিপ্রেশন বা বাইপোলার ডিজঅর্ডার থাকলে হাইপারসমনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম:
রাতে ঘুমানোর আগে মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভির অতিরিক্ত ব্যবহার করলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
ফাস্টফুড, প্রসেসড ফুড, অতিরিক্ত ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল গ্রহণ এই সমস্যার অন্যতম কারণ হতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
কিছু ওষুধ (যেমন: বিষণ্নতার ওষুধ, ব্যথানাশক, অ্যান্টিহিস্টামিন) গ্রহণের ফলে ঝিমুনি ভাব বেড়ে যেতে পারে।
ওজন ও থাইরয়েডের সমস্যা:
অতিরিক্ত ওজন বা হরমোনজনিত সমস্যা থাকলেও সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব আসতে পারে।
এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায়-
যেহেতু হাইপারসমনিয়ার স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই, তাই কিছু ভালো অভ্যাস গড়ে তুললে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
পর্যাপ্ত ও গুণগত মানসম্পন্ন ঘুম:
রাতে ৭-৮ ঘণ্টার বেশি না ঘুমানোই ভালো। অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব বাড়িয়ে দিতে পারে।
সকালে শরীরচর্চা করুন:
নিয়মিত হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করলে শরীর চাঙা থাকে, ঘুমের সমস্যা কমে।
সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন:
প্রসেসড ফুড বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার খান, বিশেষ করে প্রচুর শাকসবজি ও প্রোটিন গ্রহণ করুন।
ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল পরিহার করুন:
বেলা ৩টার পর চা, কফি বা ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন।
ডিজিটাল ডিটক্স করুন:
ঘুমানোর আগে মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভির স্ক্রিন টাইম কমান।
ওজন নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
থাইরয়েড সমস্যা বা অতিরিক্ত ওজন থাকলে ডায়েট মেনে চলুন ও প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সারাদিন ক্লান্তি লাগা, ঘুম ঘুম ভাব বা মাথা ভার লাগাকে ছোটখাটো বিষয় মনে করলেও, এটি অবহেলা করলে ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই ঘুমের রুটিন ঠিক করুন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন এবং যদি সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
এসি//