বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক, লেখক, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মুস্তাফা জামান আব্বাসী মারা গেছেন। রাজধানীর বনানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শনিবার (১০ এপ্রিল) সকাল সাতটার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। শেষবার ভর্তি হয়েছিলেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। তবে এবার শেষবারের মতো চোখ বুজলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৭ বছর।
১৯৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ভারতের কোচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। জন্মেই যেন তিনি সংগীতের এক মহাসাগরে নেমে এসেছিলেন। তার পিতা ছিলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি পল্লীগীতির কাব্যশিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদ। চাচা ছিলেন ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গানের সাধক আব্দুল করিম। বড় ভাই বিচারপতি মোস্তফা কামাল, ভাতিজি নাশিদ কামাল এবং বোন ফেরদৌসি রহমান সকলে মিলে ছিল এক পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক পরিবার। এই পরিবারটির সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল গভীর সম্পর্ক। যার ছায়াও পড়েছে আব্বাসীর সাহিত্য ও সংগীতবোধে।
আব্বাসীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতায়। স্বাধীনতার পর তিনি পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে তিনি ১৯৫৯ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৬০ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। এরপর হার্ভার্ড গ্রুপে মার্কেটিং বিষয়ে অধ্যয়ন করে তিনি নিজের জ্ঞানভাণ্ডার আরও বিস্তৃত করেন।
তার লেখার ভাষা ছিল গবেষণালব্ধ অথচ হৃদয়গ্রাহী। তার রচিত ‘গোধূলির ছায়াপথে’ কলামটি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল।লোকগানের প্রকৃত সৌন্দর্য তুলে ধরতে মুস্তাফা জামান আব্বাসী ২৫টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন। গেয়েছেন ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা, নজরুলগীতি।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। ইউনেস্কোর বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিক এর সভাপতি হিসেবে ১১ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি নিযুক্ত ছিলেন। তিনি শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না বরং, এক নির্ভরযোগ্য সংগীত-ঐতিহ্য সংগ্রাহকও ছিলেন।
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর তিনি ‘ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপ’ এর পরিচালক ছিলেন। তার সংগ্রহে ছিল কয়েক হাজার লোকগান, যেগুলোর মধ্যে ছিল অগণিত ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা গান।
তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি (দুই খণ্ড), ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি (প্রথম খণ্ডে ৬০০ গানসহ), লোকসঙ্গীতের ইতিহাস , স্বাধীনতা দিনের গান, দুয়ারে আইসাছে পালকি ছিল অন্যতম। এই সব গ্রন্থ শুধু সংগীতের সংকলন নয় একটি জাতির সঙ্গীতচেতনার প্রামাণ্য দলিল।
একজন শিল্পীকে তার সম্মাননাগুলো থেকে নয় বরং সেই সম্মানগুলো কতটা প্রাপ্য ছিল তা তার কর্মের গভীরতা থেকে বোঝা যায়। মুস্তাফা জামান আব্বাসী একুশে পদক,শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, আব্বাসউদ্দিন গোল্ড মেডেল, নজরুল একাডেমী পুরস্কার, মানিক মিয়া পুরস্কার, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তবে এগুলো তার মধ্যে অন্যতম।
তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক সুফি সম্মেলন, রুমি কর্মকাণ্ড ও এশিয়া মিডিয়া সামিটের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তার কণ্ঠে গাওয়া গান শুধু সুরে নয় আত্মার স্পর্শও থাকতো অমলিন।
এসকে//