রাত গভীর। ঘরের সবাই ঘুমিয়ে। আচমকাই কেউ বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখ খোলা, কিন্তু অভিব্যক্তিহীন। কানে নিজেরই বিড়বিড় করে কথা বলা শোনা যাচ্ছে। কখনো আবার হালকা কান্না। আশপাশের কেউ দেখলে ভয় পেতে পারেন, কিন্তু সেই মানুষটি ঘুম ভাঙার পর এসবের কিছুই মনে রাখেন না। এই রহস্যময় আচরণ চিকিৎসাবিজ্ঞানে পরিচিত ‘সমনাবুলিজম’ বা ‘স্লিপ ওয়াকিং’ নামে। এটি নিছক কোনো ভূতের গল্প নয় বরং, বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এমন এক ঘুমজনিত ব্যাধি।
স্লিপ ওয়াকিং হলো এমন একটি ঘুমের ব্যাধি, যেখানে মানুষ ঘুমন্ত অবস্থাতেই জাগ্রত মানুষের মতো আচরণ করে। হাঁটা, কথা বলা, এমনকি দরজা খুলে বাইরে চলে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছু ঘুমের মধ্যে ঘটতে পারে। যদিও এটি শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে বড়রাও কিন্তু এই সমস্যায় ভুগতে পারেন।
একজন ব্যক্তি বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন ঠিকই, কিন্তু গভীর ঘুমের মাঝেই তিনি হঠাৎ উঠে নানা কাজ করতে থাকেন নিজের অজান্তে। আশ্চর্যজনকভাবে এ সময় তার চোখ খোলা থাকলেও মন জাগে না। ঘুম ভাঙার পর তিনি কিছুই মনে রাখতে পারেন না।
স্লিপ ওয়াকিং যে কারণে হয় :
মনোবিজ্ঞান ও ঘুম গবেষণায় স্লিপ ওয়াকিংয়ের পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে :
১. শারীরিক ক্লান্তি ও অতিরিক্ত খাটাখাটুনি
২. মানসিক চাপ, ভয় বা উদ্বেগ
৩. অনিয়মিত ঘুম বা ঘুমের ঘাটতি
৪. শ্বাসজনিত ঘুমের সমস্যা, যেমন স্লিপ অ্যাপনিয়া
৫. নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
৬. পারিবারিক ইতিহাসে মা-বাবা ভুগলে সন্তানেরও ঝুঁকি বেশি
সতর্কতা :
স্লিপ ওয়াকিংয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি কখন কোথায় চলে যান, তা তারা নিজেরাই জানেন না। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে পরিবারের সদস্যদের হতে হবে অত্যন্ত সচেতন।
ঝুঁকিপূর্ণ জিনিস সরিয়ে রাখা :
ছুরি, কাঁচি বা ধারালো বস্তু দূরে রাখতে হবে।
একাকী না রাখা :
রাতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা ঘরে না রাখা ভালো।
দরজা-জানালায় লক সিস্টেম :
অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
ঘুমভাঙানোর পদ্ধতি :
সমস্যা শুরু হওয়ার ১০-১৫ মিনিট আগে ঘুম ভাঙিয়ে কিছুক্ষণ জাগিয়ে আবার ঘুম পাড়ালে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে পারে।
ঘুমের রুটিন :
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে ও উঠতে দেওয়া।
বাচ্চাদের জন্য পরামর্শ :
যদি শিশু স্লিপ ওয়াকিংয়ে আক্রান্ত হয় তাহলে মা-বাবা একটি ঘুম ডায়েরি রাখতে পারেন। তাতে প্রতিদিন কখন ঘুমিয়েছে, সমস্যা কখন শুরু হয়, কি করেছে এসব তথ্য লিপিবদ্ধ করলে চিকিৎসায় তা সহায়ক হয়। এটি কোনো মানসিক বিকার নয় বরং, একধরনের ঘুম সম্পর্কিত জটিলতা। তবে আতঙ্কের কিছু নেই। সঠিক যত্ন ও নিয়মিত ঘুমচর্চা হলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
ঘুম মানুষের বিশ্রামের সময় কিন্তু স্লিপ ওয়াকিংয়ে সেই ঘুমই কখনো কখনো অচেনা আচরণে রূপ নেয়। তবে ভয় নয় জ্ঞান, সচেতনতা আর পরিবারের সহযোগিতাই পারে এই সমস্যার সমাধান দিতে। চোখ খোলা, অথচ মন ঘুমন্ত এই দ্বৈত জগত থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যদি পাশে থাকে প্রিয়জন আর কিছু প্রয়োজনীয় সতর্কতা।
এসকে//